গবেষণা

বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ ভাগ এলাকার পানি সংকটাপন্ন

প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে এসব এলাকায় খাবার ও সেচের পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং পানি সংকটাপন্ন অঞ্চলগুলোর পরিধি প্রসারিত হচ্ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাজুড়ে ‘উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতির হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং জুন মাসে ওয়ারপো কর্তৃক অনুমোদিত হয়। সরকার ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) যৌথ অর্থায়নে আগস্ট মাসের প্রথমদিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন, ওয়ারপোর মহাপরিচালক রেজাউল মাকসুদ জাহেদী। এই জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য, গবেষণাটিতে পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে সংকটের তীব্রতা অনুযায়ী বিকল্প হিসেব ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস্য ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠের পানির সম্মিলিত ব্যবহার উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর হটস্পট হিসেবে বিবেচিত উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিসম্পদ সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন গবেষণা পর্যালোচনার সঙ্গে জড়িত অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবন পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ক্ষয়িষ্ণু পানিসম্পদগুলো দ্রুত পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা জরুরি।’ গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালে এ অঞ্চলের গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৮ মিটার। তবে তখনোই গোমস্তাপুর ও তানোর উপজেলার অল্প কিছু এলাকায় সর্বোচ্চ স্তর ছিল ২১ মিটার। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষ এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে, ২০১০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির গড় স্তর ১৫ মিটার ছাড়িয়ে যায়। ২০২১ সালের মধ্যে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ১৮ মিটারে বৃদ্ধি পায় এবং কিছু কিছু এলাকা যেমন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে একটি স্থানে সর্বোচ্চ ৪৬.৮৭ মিটার রেকর্ড করা হয়। উল্লেখ্য, গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি বলতে ভূগর্ভস্থ পানির হ্রাসকে নির্দেশ করে। গবেষণায় আরো উল্লেখ আছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনেরও অবদান আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কম বৃষ্টিপাত, খরা ও ভূগর্ভস্থ পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে। গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানির বিস্তারিত মূল্যায়ন করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলাধার যাকে অ্যাকুইফার বলা হয়, সেখানে বালিকণার ফাঁকে ফাঁকে পানি জমে থাকে। ভূপৃষ্ঠের পানি ও বৃষ্টিপাত মাটির মধ্য দিয়ে অ্যাকুইফারে প্রবাহিত হয়। অ্যাকুইফারগুলোতে বর্ষা মৌসুমে যে পরিমাণ পানি জমা হয় তা রিচার্জ হিসেবে ধরা হয়। গবেষণায় অ্যাকুইফারগুলোতে পানির প্রকৃত রিচার্জ এবং সেখান থেকে কতটুকু পানি উত্তোলন নিরাপদ তা নির্ণয় করা হয়েছে এবং তাকে পানির নিরাপদ ফলন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির প্রকৃত রিচার্জ ও পানির নিরাপদ ফলন মূল্যায়ন করে গবেষণায় ২৫টি উপজেলায় পানির সংকট পরিস্থিতি নির্ধারণ করা হয়েছে। পানি সংকট বলতে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারযোগ্য পানি প্রাপ্যতার তুলনায় পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়া বোঝানো হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাসের কারণে এই সংকট তৈরি হয়। দেখা গেছে, এই অঞ্চলের মোট ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ কমপক্ষে ৮৭টি ইউনিয়নকে ‘অতি উচ্চ’ ও ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পানি সংকটাপন্ন এই ইউনিয়নগুলোতে অপর্যাপ্ত অ্যাকুইফার রিচার্জের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আগের বর্ষা থেকে পরের বর্ষায় হ্রাস পায়। অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে পোরশা উপজেলার ৬ ইউনিয়নের সবগুলো এবং নাচোল উপজেলার ৪ ইউনিয়নের সবগুলো।