এক বছরে ২৮ শতাংশ কমেছে
কমেছে কৃষিপণ্য রপ্তানি
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণে হলে এই খাত সরকারের নগদ প্রণোদনা ও বিভিন্ন দেশের দেওয়া রপ্তানি সুবিধাগুলো হারাবে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা এবং নীতিগত অগ্রাধিকার দেওয়া সত্ত্বেও মানসম্মত পরীক্ষাগারের অভাব ও দুর্বল প্যাকেজিংয়ের মতো বেশকিছু কারণে বাংলাদেশ এ খাতের পূর্ণ রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না। এমনটাই বলা হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে। নতুন খাত হিসেবে রপ্তানিতে আশা দেখাচ্ছিল কৃষিজাত পণ্য। ৫ বছরের ব্যবধানে এই খাতের পণ্য রপ্তানি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে তাজা ও হিমায়িত উভয় ধরনের সবজিই রপ্তানি হয়। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে সবজির হিস্যা সাড়ে ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে কৃষিজাত পণ্যের সামগ্রিক রপ্তানি বাড়লেও সবজি ছিল নিম্নমুখী। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৭৪ লাখ ডলারের সবজি রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৫ শতাংশ কম। সবজি রপ্তানিকারকরা বলেছেন, করোনার পর উড়োজাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে সবজি রপ্তানি কমেছে। ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার আগে প্রতি কেজি সবজি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে ১৫০ টাকায় পাঠানো যেত। বর্তমানে লাগছে ২৫০ টাকার কাছাকাছি। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যে উড়োজাহাজ ভাড়া বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এই সুযোগে বাজারটি দখল করছেন ভারতের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে প্রচুর পোশাক যায়। পোশাকের ক্ষেত্রে যে ভাড়া আদায় করা হয়, সেই একই ভাড়া সবজির বেলায়ও রাখা হচ্ছে। ফলে সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী উড়োজাহাজে পোশাক রপ্তানি হয় না বলে কম ভাড়ায় সবজি রপ্তানি করতে পারেন সেই দেশের রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশ ফ্রুট, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের ব্যবসায়ীরা আমাদের বাজার দখল করছেন।’ তিনি জানান, করোনার আগে দেশে দুই শতাধিক সবজি রপ্তানিকারক ছিলেন। বর্তমানে তা কমে ১০০ থেকে ১৫০ জনে নেমে এসেছে। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের হিস্যাই বেশি। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে মসলা, চানাচুর, ঝালমুড়ি, বিস্কুট, সস, জেলি, আলুপুরি, পাঁপড়, নুডলস, চকলেট, বিভিন্ন ধরনের আচার, জুস, ফ্রুট ড্রিংক, চিপস ইত্যাদি রপ্তানি হয়। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কঠিন সময় যাচ্ছে। তবে আমরা উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সামগ্রিক রপ্তানি কমলেও আমাদের কমেনি।’ বর্তমানে ১৮টি দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয় ও মশলা রপ্তানি করে হিফস অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ৩২ লাখ মার্কিন ডলারের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি করেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস (জুলাই-মে) পর্যন্ত ৮০ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি ছিল ১১০ কোটি ডলারের। এ সময়ে কমে গেছে চা, তাজা সবজি, ফুল, ফল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার রপ্তানি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলেছে, ১২ বছর আগেও কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৪০ কোটি ডলার। শেষ ছয় বছর খাতটির রপ্তানি আয় দ্রুত বাড়ছিল। এর মধ্যে শুধু করোনার শুরুতে প্লেন বন্ধ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি পাঁচ শতাংশ কমেছিল, যা পরের বছরই ভালো অবস্থানে যায়। এরপর এ বছরই বড় হোঁচট খেতে যাচ্ছে এ খাতের রপ্তানি আয়। খাত সংশ্লিষ্টরা অন্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য খাদ্যপণ্যের দাম বেশি হওয়াকে রপ্তানি কমার অন্যতম একটি কারণ বলছেন। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি সবজির মতো কৃষিপণ্যের দাম। প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামালের দামও বেশি। যে কারণে আটা, ময়দা, তেল, চিনির মতো পণ্যগুলোর মাধ্যমে তৈরি হিমায়িত খাবারের খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে রয়েছে ডলার সংকটে চলতি বছর কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়া, ব্যয় বাড়া, এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি জটিলতা। পাশাপাশি দেশ থেকে সুগন্ধি চালের রপ্তানি বন্ধ থাকায় সেই বাজার হারানো এবং সুগন্ধি চালের কারণে অন্য পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমেছে।
জানা গেছে, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রপ্তানি হয় রুটি, বিস্কুট ও চানাচুরজাতীয় শুকনা খাবার, ফলের রস (জুস), বিভিন্ন ধরনের মশলা, পানীয় এবং জ্যাম-জেলির মতো বিভিন্ন সুগার কনফেকশনারি। শেষ ১১ মাসে কোম্পানিগুলো ২৩ কোটি ডলারের এ ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা গত বছর একই সময়ে ২৭ কোটি ডলার ছিল। এটা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ কম। এছাড়া কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাড়তি ফ্রেইট চার্জ একটা বড় বাধা বলে উল্লেখ করেছেন রপ্তানিকারকরা। ফ্রেইট চার্জের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। এটা একটা বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।