ডলারের পর এবার টাকার ঘাটতি
অর্থ সংকটে ভুগছে বিদ্যুৎ
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া ২৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পিডিবির পাওনা ২৮ হাজার কোটি টাকা।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি; কিন্তু তা দিয়ে ১৪ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদাই পূরণ করা যাচ্ছে না। মূলত টাকার অভাবে পাওয়া যাচ্ছে না চাহিদামতো বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া পড়ে আছে, ফলে প্রয়োজনীয় জ্বালানি কেনা যাচ্ছে না। এর মধ্যেও চলছে অব্যবস্থাপনা-অপচয়। এসব কারণে ঢাকার বাইরে একটি বড় অংশে নিয়মিত চলছে লোডশেডিং। চুক্তি অনুসারে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা তা পাইকারি দামে বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। গত এক বছরে দুই দফায় পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এরপরও বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি পূরণে সরকার ভর্তুকি দেয়। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, গত এপ্রিল পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পাওনা ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ ভর্তুকির টাকা নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। এতে পিডিবির কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের কাছে প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার চাহিদা জানিয়েছে পিডিবি। বর্তমান সক্ষমতায় চাইলে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু নানা কারণে তা করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়াও আছে। তবে ভর্তুকির টাকা বাজেটে বরাদ্দ আছে, এটা ধাপে ধাপে ছাড় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত মাসে মাত্র ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। ভর্তুকির পাওনা আদায়ে গতকাল মঙ্গলবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবি। চলতি মাসে আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। মাসের প্রথম সপ্তাহেই এটি করা হতে পারে। যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমাতে নিয়মিত তাগাদা দিচ্ছে অর্থ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগের দুইজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সাশ্রয়ে লম্বা সময় ধরে আমদানি কমানো হয়েছে। সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। তাই চাইলেও এখন চাহিদামতো টাকা দিতে পারবে না অর্থ বিভাগ। আবার নির্বাচন সামনে রেখে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও সুযোগ নেই। তাই শিগগিরই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া শোধ করতে পারবে না পিডিবি। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বর্তমান সক্ষমতায় চাইলে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু নানা কারণে তা করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়াও আছে। তবে ভর্তুকির টাকা বাজেটে বরাদ্দ আছে, এটা ধাপে ধাপে ছাড় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া এর মধ্যে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো একের পর এক উৎপাদনে আসছে। এতে উৎপাদন খরচও কমে আসবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) জানাচ্ছে, গত সোমবারও ঘণ্টায় সর্বোচ্চ দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে। এরপর রাতে বৃষ্টি নামার পর চাহিদা কমায় লোডশেডিং কমেছে। গতকাল দিনের বেলায়ও ঘণ্টায় এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং ছিল। তবে ঢাকা শহরে কোনো লোডশেডিং করা হচ্ছে না।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ বলছে, গত সোমবার রাত ১২টা থেকে মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত গড়ে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি ছিল। এক বছরের বেশি সময় ধরেই এখানে লোডশেডিং চলছে। আর গাজীপুরে লোডশেডিং করা হয় ২৪ দশমিক ১৩ ভাগ। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। কিন্তু গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকছে নিয়মিত। গ্যাসভিত্তিক ১১ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে গড়ে উৎপাদন করা হচ্ছে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াটের মতো। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ২৭টি থেকে বেড়ে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে ১৫৩টি। বিচ্ছিন্ন চর, দুর্গম পাহাড়েও বিদ্যুৎ-সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদযাপন করা হয়েছে। কিন্তু সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারিগরি নানা কারণে একটি বড় অংশের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে আছে। আর মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিন ভাগের এক ভাগ ভুগছে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলের অভাবে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি পুরোপুরি বন্ধ, আবার কিছু কেন্দ্র থেকে সক্ষমতার আংশিক উৎপাদন হচ্ছে। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। কিন্তু গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকছে নিয়মিত। গ্যাসভিত্তিক ১১ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে গড়ে উৎপাদন করা হচ্ছে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াটের মতো। ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ৬৫টি। মোট উৎপাদন ক্ষমতা ছয় হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে ২৫ থেকে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির অভাবে নিয়মিত উৎপাদন করতে পারছে না। এতে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সব মিলে গড়ে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক বা না করুক, চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ভাড়া দিতে হয় পিডিবির। এটি কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্র ভাড়া ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে পিডিবি কেন্দ্র ভাড়া পরিশোধ করেছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্র ভাড়া ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।