পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত
ঋণ দিতে পারবে না ইসলামী ব্যাংকের কোনো শাখা
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
আর কোনো ঋণ দিতে পারবেন না ইসলামী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকরা (ব্রাঞ্চ ম্যানেজার)। এমনকি বিভাগীয় ও জোন প্রধানরাও কোনো ঋণ অনুমোদন করতে পারবেন না। পাশাপাশি ঋণের সীমাও বাড়াতে পারবেন না তারা। তবে কৃষি খাতে তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা বহাল রাখা হয়েছে। ব্যাংকটির মোট ঋণের মাত্র ৩ শতাংশ দেওয়া হয়েছে কৃষিতে। আগে সবক্ষেত্রে শাখা ব্যবস্থাপক ও জোন প্রধানরা পদক্রম ভেদে সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করতে পারতেন, যার বড় অংশই যেত গ্রামীণ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের কাছে। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে এসেছে। এখন সব ঋণ দেওয়া হবে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনে। এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করতে পারবেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। গত ১৯ জুন ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩২৪তম সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভাতেই পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন আহসানুল আলম। তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে। এর আগে আহসানুল আলম ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা নেওয়ার পর এবারই প্রথম পরিবারের সদস্যদের ব্যাংকে যুক্ত করে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়া করার জন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাত ব্যাংক থেকে বিদেশে টাকা পাচারের তথ্য নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে।
মহামান্য আদালত তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ঋণ অনুমোদনসংক্রান্ত পর্ষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ২০ জুলাই শাখা পর্যায়ে চিঠি দেন ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ মুনিরুল মওলা ও মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী। নানা অনিয়মের কারণে তারল্যসংকটে পড়ার পর বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানা গেছে। আগে জ্যেষ্ঠ মুখ্য কর্মকর্তা শাখা ব্যবস্থাপক পদে কর্মরত থাকলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ঋণ দিতে পারতেন। এর ওপরের পদের ব্যবস্থাপকদের ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা ছিল। আর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধান বা জোনাল প্রধানদের ঋণ অনুমোদনের সীমা ছিল ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত। সারা দেশে ইসলামী ব্যাংকের শাখা রয়েছে ৩৯৪টি। প্রতিটি শাখার অধীনে আছে একাধিক উপশাখা। ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতাসংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত যেকোনো ধরনের নতুন ঋণ বা ঋণের সীমা বৃদ্ধির অনুমোদন করবেন এমডি। ৫০ লাখ টাকার বেশি ঋণ বা ঋণের সীমা বৃদ্ধির অনুমোদন দেবে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটি। তবে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণের ক্ষেত্রে আগের ক্ষমতাই শাখা ব্যবস্থাপকদের হাতে বহাল থাকবে। আর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়নের আওতায় ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করতে পারবেন এমডি। এর বেশি হলে তা নির্বাহী কমিটি ও পরিচালনা পর্ষদে যাবে। ফলে শাখা পর্যায় থেকে কৃষিঋণ ছাড়া অন্য কোনো ঋণ অনুমোদন দেওয়া যাবে না। তবে কৃষিঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা তুলে না নিলেও তা বন্ধ রয়েছে বলে জানান ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা। ইসলামী ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন, জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঋণ বিতরণ ও ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষমতা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংকটির ২০২২ সালভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, তাদের দেওয়া ঋণের ৫৩ শতাংশ শিল্প খাতে, ৩২ শতাংশ ব্যবসা বা ট্রেডিং খাতে ও ৬ শতাংশ আবাসন খাতে গেছে। ভোক্তা ও কৃষি খাতে ৩ শতাংশ করে ঋণ গেছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শাখা পর্যায়ে ব্যাংকটির বেশির ভাগ ঋণ প্রদান বন্ধ থাকবে। জানা গেছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের কাছে যাওয়ার পর নামে ও বেনামে বিভিন্ন শাখা থেকে ঋণের নামে টাকা বের করা হয়।
এসব ঋণের বেশির ভাগের আকার ৯০০ কোটি টাকার মধ্যে। কারণ, ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটি ৯০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করতে পারে। এর বেশি ঋণ হলে তা অনুমোদনের জন্য পরিচালনা পর্ষদে পাঠানোই ছিল নিয়ম। এই সময়ে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন যথাক্রমে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল মতিন ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সেলিম উদ্দিন। জুনে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন এস আলমের ছেলে আহসানুল আলম, আর গ্রুপটির মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয় সেলিম উদ্দিনকে। এখন ইসলামী ব্যাংক তারল্যসংকটে ভুগছে। আমানত যা জমা আছে, ঋণ গেছে তার চেয়ে বেশি। ফলে ঋণ-আমানতের অনুপাত সীমা ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংকটি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে না পারায় ব্যাংকটি নিয়মিত জরিমানা খাচ্ছে। এরপরও জমা হওয়া আমানত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের কিছু হলে পুরো ব্যাংক খাতে এর প্রভাব পড়বে, ঝুঁকি তৈরি হবে। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় কিছু করা যাচ্ছে না। ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে তা-ও প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।