বরগুনার আমতলীর মো. মোজাম্মেল। পেশায় তিনি রিকশাচালক। গত ১৩ মে কারা জেলার পরিচয় দিয়ে বলা হয়- ‘তোমার আব্বা বরিশাল কারাগারে রয়েছে। সিরিয়াল নম্বর-৭১। সরকারিভাবে কিছু লোক জেলখানা থেকে ছাড়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে তোমার বাবা রয়েছে। ৪০ হাজার টাকা পাঠালে তোমার বাবাকে জামিনের ব্যবস্থা করিয়ে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে।’ এর পর জালিয়াত চক্রকে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরে ৪০ হাজার টাকা পাঠানোর পরও দরিদ্র রিকশাচালক তার বাবাকে ফেরত না পেয়ে হতাশ হন। এ ঘটনায় মিরপুর থানায় মামলাও দায়ের করেন তিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মাড়েলহাট গ্রামের বাসিন্দা মো. ফারাজুল হক। সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলে গ্রামে গিয়ে দুই ব্যক্তি কৌশলে তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ছবি নেন। এর পর একটি মেশিনে তার ফিঙ্গারপ্রিন্টও নেওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ফারাজুলকে এক কেজি আটা দেন তারা। একইভাবে মাথাপিছু এক কেজি আটার বিনিময়ে তার বাড়ি থেকে আরো চার-পাঁচজনের এনআইডি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়। গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলোর বোঝার সাধ্য ছিল না কী ভয়ংকর জালিয়াতির ফাঁদে পড়ছে তারা। তাদের অজান্তেই এনআইডি ও আঙুলের ছাপের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খোলা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব।
সেগুলো দিয়ে আবার জালিয়াতির কাজে ব্যবহার করে লাখ লাখ প্রতারণামূলক লেনদেন করা হচ্ছে। শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের ওই ঘটনা নয়, দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলার দরিদ্র লোকজনকে নানা সহযোগিতার ফাঁদে ফেলে তাদের এনআইডি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ নিয়ে খোলা হয়েছে লাখো মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব সিমকার্ড ভয়াবহ সব অপরাধী চক্রের হাতে তুলে দিচ্ছে জালিয়াত চক্র। যাদের তথ্য নিয়ে এসব হিসাব খোলা হয়েছে, তারা থাকেন পুরোপুরি অন্ধকারে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর চালু করে দিনের পর দিন চলছে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, জালিয়াত চক্রটি প্রথমে প্রতারণামূলক মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর খোলে। তাদের কৌশল হলো, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক অসাধু ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার ও ডিস্ট্রিবিউশন সেলস সুপারভাইজার তাদের কোম্পানির এজেন্টের মাধ্যমে ওয়ান টাইম পিন (ওটিপি) নিয়ে থাকে। এরপর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে তাদের এনআইডি নম্বর নিয়ে হিসাব নম্বর খোলে। এরপর এসব মোবাইল সিমগুলো টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয়। এভাবে হিসাব নম্বর খোলার পর তা অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের কাছে বিক্রি করে জালিয়াত চক্রটি। তদন্তকারী কর্মকর্তারা আরো জানান অ্যামাজন ডট থ্রি এস ডট কম। যেখানে বিনিয়োগ করলে মোটা অঙ্কের লাভ মিলবে এই ফাঁদে ফেলে ভুয়া অ্যামাজন প্ল্যাটফর্ম থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার লোকজনকে ফতুর করা হয়েছে। জালিয়াতির এই ঘটনায় করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এমটিএফইর প্ল্যাটফর্ম থেকে জালিয়াতি করতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যেসব নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে, একই নাম্বার অ্যামাজন চক্রের কাছেও ছিল। গ্রেপ্তারকৃত অনিকের কাছ থেকে ছয়টি মোবাইল ও ২৮টি সিমকার্ড উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি সিমকার্ডের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর খোলা রয়েছে। তবে তার মধ্যে একটি মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বরও অনিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ব্যবহার করে খোলা হয়নি। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চকরিয়ায় তোরাব আলী নামে তার চাচাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় তার বাসা থেকে ৬৮টি সিমকার্ড জব্দ করে পুলিশ। মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, গ্রেপ্তারকৃত চক্রটি কয়েক লাখ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব অবৈধভাবে খুলেছে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তারা স্বাস্থ্যকার্ড দেয়ার নামেও কৌশলে অনেকের এনআইডি ও আইরিশ নিয়েছিল। যেসব দরিদ্র মানুষের এনআইডি কার্ডের বিপরীতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলে লাখ লাখ টাকার লেনদেন চলছে তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নয় বলেও জানান তিনি। পুলিশের মিরপুর বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার হাসান মুহাম্মদ মুহতারিম বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংসেবার সঙ্গে যুক্ত, তারা সচেতন না হলে এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকানো কষ্টসাধ্য হবে। অপরাধ করেও অনেকে পার পেয়ে যাবে। আবার সতর্ক না হলে নিরপরাধ লোকজন ফেঁসে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
আর্থিক খাতে সাইবার ক্রাইম ঠেকানো যাচ্ছেনা কেন?
বাংলাদেশে পুলিশ বলেছে, দেশে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যতরকম অপরাধ হয়, তার মধ্যে অর্থনৈতিক অপরাধের সংখ্যা বেশি বেড়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা অভিযোগ জানাতে আসে না, যে কারণে এসব ঘটনা থেকে যায় আইনি ব্যবস্থার বাইরে। যদিও মোবাইল ব্যাংকিং করতে গিয়ে কিংবা বিকাশে অর্থ লেনদেন করতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, চারপাশে প্রায়ই এমন কথা শোনা যায়। রফিকুল ইসলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। এক দুপুরে তার কাছে অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ফোন আসে। নিজেকে ডাচ বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস রকেটের একজন নির্বাহী পরিচয় দিয়ে কথা বলেন এক ব্যক্তি। আদতে ওই ব্যক্তি ছিলেন একজন প্রতারক, যিনি ফাঁদে ফেলে মি. ইসলামের পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। আমাকে বললো যে ওই দিনের মধ্যে আপনার অ্যাকাউন্ট নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, আপনি ব্রাঞ্চে গিয়েও করতে পারেন, আবার আমাদের এখানে ফোনেও করতে পারেন। আমার হাতে সময় ছিল না, তাই তাদের নির্দেশনা মত স্টেপ ফলো করি।