নিউ অক্সফোর্ড অ্যাডভান্সড লার্নারস ডিকশনারি ‘সিন্ডিকেট’-এর সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছে, সিন্ডিকেট হল একদল ব্যক্তি বা কোম্পানি, যারা সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে পরস্পরের স্বার্থ সুরক্ষায় একত্রে কাজ করে। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে এ দেশের জনসাধারণ সময়ে সময়ে বিভিন্ন দ্রব্য, বিশেষ করে নিত্যপণ্য ক্রয়ে উচ্চমূল্যের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। বিভিন্ন পণ্যের জন্য ব্যবসায়ীদের রয়েছে আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেশনের ফলে যেসব নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে জনসাধারণ উচ্চমূল্যের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন, সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল: চাল, গম, চিনি, ভোজ্য পতল, গুঁড়াদুধ, ইলিশ মাছ, মাংস, ডাল ও শাকসবজি। খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোর পেছনেও রয়েছে সিন্ডিকেট। পণ্যের বাইরে সিন্ডিকেশনের কারণে যেসব খাতে জনগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- মানুষের যাতায়াতের জন্য সড়কপথে বাস, সিএনজিচালিত থ্রি-হুইলার, জলপথে স্টিমার ও লঞ্চ এবং স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। আমাদের প্রধান খাদ্য চালের কথায় আসা যাক। দেশের কম-বেশি ৯০ শতাংশ মানুষের শর্করার জোগান দেয় চাল। বাকিটা আসে গম ও ভুট্টা থেকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের কিছুটা বেশি হলেও চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে তিন গুণেরও বেশি। চাল উৎপাদনে আমরা স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি।কিন্তু চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের গঠিত সিন্ডিকেটের কারণে ধানচাষী ও ভোক্তারা বারবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চাল উৎপাদনে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বোরো ও আমন ধান কাটার মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযানে সরকারের স্বল্প পরিমাণ ধান কেনা এবং নানা জটিলতার কারণে সরকারি সংগ্রহ অভিযান দেরিতে শুরু হওয়ার সুযোগ নিয়ে চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে ধানচাষীদের, বিশেষ করে ধারদেনা শোধ ও পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে মৌসুমের শুরুতেই ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষীদের বাজারে নিয়ে আসা ধান সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে কিনে মজুদ করেন। মৌসুম শেষে যখন আর কারও কাছে ধান থাকে না, তখন তারা মজুদ ধান চালে রূপান্তর এবং সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চমূল্যে চাল বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেন।
বর্তমানে এদের কারনে দিশাহারা দেশের মানুষ। কারণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই রোজগারের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে। বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম নাগালের মধ্যে আছে। তাই মাস শেষ হওয়ার আগেই টান পড়ছে পকেটে। তিন বেলা খেয়ে-পরে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে অনেকের জন্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, মুরগি, তেল ও ডিম অন্যতম। এই সাতটি পণ্য ঘিরেই তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। টিসিবির তথ্য মতে, ২০২০ সালের ২২ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট সময়ে সরু চালের দাম কেজিতে সর্বনিম্ন বেড়েছে চার টাকা। একই হারে বেড়েছে মোটা চালের দামও। টিসিবি বলেছে, তিন ধরনের চালের মধ্যে ২০২০ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীতে সবচেয়ে ভালো চিকন চাল কেজিতে বিক্রি হয়েছিল ৫৪ থেকে ৬৮ টাকায়। সেই চাল ২০২১ সালের একই সময়ে বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৬৮ টাকায়। ২০২২ সালের একই সময়ে বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৮০ টাকা এবং বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭২ টাকা কেজিতে। যদিও টিসিবির এ দামের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল নেই। গত ২১ আগস্ট রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজিতে। টিসিবির তথ্য মতে, মাঝারি মানের চাল (যেমন বিআর-২৮, বিআর ২৯ এবং পাইজাম চাল) ২০২০ সালের এই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা। ২০২১ সালে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৬ টাকা, ২০২২ সালে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। কিন্তু রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখন কোথাও ৬০ টাকার নিচে এ চাল বিক্রি হচ্ছে না। টিসিবির তথ্য মতে, ২০২০ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীতে বড় মসুর ডাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে। যদিও খোলাবাজারে এ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। ছোট মসুর ডাল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা কেজি। গত বছর একই সময় এ ডাল বিক্রি হয়েছিল ১২৫ টাকায়। টিসিবির দাবি, বাজারে প্রতি কেজি ডায়মন্ড আলুর দাম ৩৬ থেকে ৪০ টাকা। বাস্তবে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।
একই আলু ২০২০ সালের একই সময়ে বিক্রি হয় ৩৪ থেকে ৩৫ টাকায়, ২০২১ সালে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা, আর ২০২২ সালে বিক্রি হয় ২৬ থেকে ৩০ টাকা কেজি। ২০২০ সালে ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১১০ টাকা। সেই তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। ২০২২ সালে এ তেলের দাম আরো বেশি ছিল। সে সময় লিটার প্রতি বোতলজাত তেলের দাম ছিল ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা। কিন্তু ২০২১ সালে ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে আমাদেরও তেলের দাম বাড়াতে হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে আমরাও কমে বিক্রি করতে পারি। আমরা ব্যবসায়ী হলেও দিন শেষে আমরাও ভোক্তা। সবসময় চেষ্টা করি তেলের দাম কমাতে। বর্তমানে বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে এক হালি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। টিসিবি বলেছে, ফার্মের ডিম (লাল) হালি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫৩ টাকা। ৩ বছর আগে এক হালি ডিমের দাম ছিল ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা। তার পরের বছর ২০২১ সালেও ছিল ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা। ২০২২ সালে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা হালি। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলেছে, গত বছর এই সময় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এদিকে পেঁয়াজের পাশাপাশি গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে রসুনের। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে দেশি রসুন ২২০ থেকে ২৪০ টাকা ও আমদানিকৃত রসুন ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলেছে, বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজের কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা; এক সপ্তাহ আগে যা ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। তাদের হিসাবে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫ টাকা। সপ্তাহ ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে এসব বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ১৭০ টাকা দরে। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় খুচরা দাম বেড়েছে। তালতলা বাজারের মুরগি বিক্রেতা আউয়াল বলেন, গত সপ্তাহের চেয়ে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ায় আমরাও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছি।