সম্প্রতি পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের ৪০ শতাংশ শুল্কারোপের পর, হঠাৎ করে দেশে পেঁয়াজের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এমনিতেই সিন্ডিকেটের আমদানি করা পেয়াজ মূল্য সব মিলিয়ে ২২ টাকা। তখনও বাজারে ৫০ টাকার বেশি। বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়, যার ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। সেজন্যই ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়ে। এবার এই সংকটের পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকলেও প্রতিবারই ভুগতে হয় ভোক্তার। হার্টের জন্য উপকারী পেঁয়াজ কারণ হয়ে দাঁড়ায় হার্ট অ্যাটাকের। একই ঘটনা ঘটে চিনি, গম, ভুট্টা, মসুর ডাল কিংবা মসলা যেসব দেশ থেকে আসে, তারা রপ্তানি বন্ধ করলেও। যদিও বাংলাদেশে বছরের খাদ্যশস্য ও মসলার যে চাহিদা তার প্রায় সবই দেশে উৎপাদন হয়। কিন্তু এর বাইরে একটি বড় অংশের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে চাল, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নানারকম নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য রয়েছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। কিন্তু তারপরও বিদেশ নির্ভরতা কমছে না। কোনো কারণে আমদানিতে টান পড়লেই টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয় বাজারে। সংকট থেকে উত্তরণে সংগ্রহোত্তর সংরক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দেয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের ৪০ শতাংশ শুল্কারোপের পর খুচরা বাজারে পণ্যটি কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। ক’দিন আগেও যা ছিল ৫০ এর ঘরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় তা দিয়ে অনায়াসেই মেটানো সম্ভব চাহিদা। এই যেমন গত বছর পেঁয়াজের ফলন হয়েছে ৩৬ লাখ টন। বিপরীতে চাহিদা ছিল মাত্র ২৪ লাখ টন। অর্থাৎ, যা লাগবে তার চেয়েও ৬ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। তারপরও গত বছর পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি, তারপরও কেন বিদেশ নির্ভর হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে তা নিয়ে জরিপ চালায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। আমদানি পণ্যের মধ্যে এক পঞ্চমাংশ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আমদানি হয় চীন থেকে, মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি। তালিকায় এর পরই রয়েছে ভারত, যে দেশটি থেকে মোট আমদানির প্রায় ১৫ শতাংশ আমদানি হয়। এরপর ক্রমে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত রয়েছে। বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন, আউসের বাম্পার ফলন এবং মজুত ভালো থাকা সত্ত্বেও কমছে না চালের দাম। দেশের প্রধান খাদ্য চালের বাজার সহনীয় করতে ও আমদানি বাড়াতে শুল্ক কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে যে খাদ্য সামগ্রী আমদানি করা হয়েছে, তার শীর্ষ ১০টি পণ্যের মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে অপরিশোধিত চিনি, পাম তেল, সয়াবিন তেল, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, আদা, মরিচ, গম, চাল, মসুর ডাল এবং পেঁয়াজ। এছাড়া রসুন, চা, তেলবীজ এবং হলুদ রয়েছে শীর্ষ খাদ্যসামগ্রী আমদানির মধ্যে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আমদানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন। তারা বলেন, আমদানি হ্রাসে, আমদানিতে নিয়ন্ত্রণের ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফল হয়। স্বনির্ভরতা আসে। আত্মনির্ভরশীলতা ফিরে আসে। সরকার যদি আমদানিতে কঠোর থাকেন, তাদের ভূমিকার কারণে এবং বর্তমান কঠোর আমদানি নীতির ফলে আমরা কিছুটা ভালো ফল পাব। ডলার সাশ্রয় এক কথা, বিপরীতে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি বৃদ্ধির ঘটনা অর্থনীতিবিদদের কিছুটা হতাশ করছে। অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. আরএম দেবনাথ বলেন, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে।
সংকটে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ছে ভারতের ওপর
করোনার পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জাহাজভাড়া বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম, চিনিসহ পণ্য আমদানিতে ভারত-নির্ভরতা বেড়েছে। গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৬৮৯ কোটি ডলারের পণ্য, আমদানি বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। ভারত থেকে গম আমদানি এক বছরের ব্যবধানে বেড়ে তিন গুণ হয়েছে।
বৈশ্বিক চলমান সংকটে বিশ্বের আমদানি বাণিজ্যের গতিপথ কিছুটা বদলে গেছে। সেই বদলের পথে হেঁটেছে বাংলাদেশও। সহজ যোগাযোগ ও কম খরচের সুবিধার কারণে গত কয়েক মাসে দেশে নানা ধরনের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত-নির্ভরতা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাতে ভারত থেকে পণ্য আমদানি রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে।
দেশে ধান নিয়ে সার্বক্ষণিক গবেষণা করছেন ৩০০ কৃষি বিজ্ঞানী। তবে, অন্যান্য খাদ্য পণ্য নিয়ে নিবেদিত গবেষণাকারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। ক্রমবর্ধমান দুগ্ধ শিল্পের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে নানান দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিখাতের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে সরকার ৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭৩ শতাংশ ফসলি জমি ব্যবহৃত হয় ধান চাষে, যা অতীতে ৮০ শতাংশেরও বেশি ছিল। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া গমের ৬৩ শতাংশই এসেছে ভারত থেকে। একসময় রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে সিংহভাগ গম আমদানি হতো। শুধু গম নয়, এ তালিকায় রয়েছে অপরিশোধিত চিনি, চাল, ডিজেল, সুতা ও পোশাক খাতের কাঁচামাল ইত্যাদি। উল্লিখিত সব পণ্য আমদানি আগের তুলনায় বেড়েছে। চিনির বাজারের উদাহরণ দেওয়া যাক। দেশের অপরিশোধিত চিনির বাজার পুরোপুরি ছিল ব্রাজিলনির্ভর। জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় চিনি আমদানিতেও উৎসস্থল পরিবর্তন হয়ে ভারতনির্ভর হয়ে পড়ে। দেশের পরিশোধন কারখানাগুলো গত অর্থবছরে ভারত থেকে সাড়ে ১০ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে, যা মোট আমদানির ৪৪ শতাংশ। এক বছর আগে মোট আমদানি হওয়া চিনির মাত্র ৪ শতাংশ এসেছিল ভারত থেকে।
বেড়েছে বাণিজ্যঘাটতিও
আমদানির পাশাপাশি ভারতে রপ্তানিও বেড়েছে। এরপরও বাণিজ্যঘাটতি বেড়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, গত অর্থবছর ভারতে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, গত অর্থবছর (জুলাই-জুন) দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৪৯০ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
গত অর্থবছরে যে ২৫ পণ্য বেশি আমদানি হয়েছে
আমদানি করা ৪ হাজার ৭৮৮ ধরনের পণ্যের মধ্যে ২৫টি পণ্যের জন্য ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল ২৫টি পণ্যের দখলে। এই ২৫টি পণ্যের বেশিরভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, নির্মাণ সমগ্রী এবং অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল। গত অর্থবছরে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর দিয়ে ৪ দশমিক ৬২ লাখ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৮৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন পণ্য আমদানি হয়েছে। আমদানি করা ৪ হাজার ৭৮৮ ধরনের পণ্যের মধ্যে মাত্র ২৫টি পণ্যের জন্য ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে আছে- তুলা, ডিজেল, ক্র্যাপ জাহাজ, ফার্নেস অয়েল, পাম অয়েল, সিমেন্ট ক্লিংকার, গম, অপরিশোধিত তেল, সার, সয়াবিন, হট রোল্ড ইস্পাত, মসুর ডাল, লোহা ও ইস্পাত কাঠামো, ভাঙা পাথর এবং মোটর।