ফুল রপ্তানিতে সম্ভাবনা
বছরজুড়ে ১৫০০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/দুটি যদি জোটে অধের্ক তার ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী!’ মানুষের জীবনে ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম। কত সহস্র উপমায় বিশেষায়িত এই ফুল। কত শত কবি তার কবিতায় ফুলের গুণকীর্তন করেছেন। শুদ্ধতা, পবিত্রতা ও সৌন্দযের্র প্রতীক, ভালোবাসার অর্ঘ্য, শ্রদ্ধা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপকরণ, প্রাথর্নার নৈবদ্য হিসেবে ফুলের ব্যবহার আরো কত কী! ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া কঠিন। জগৎজুড়ে ফুলের ব্যবহার বতর্মানে যেমন চলছে ভবিষ্যতেও চলবে। ফুল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মননশীলতার প্রতীক। উপহার, সংবধর্না, গায়ে হলুদ, বিয়ে, পূজা-পাবর্ণ এমনকি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতায় ফুল এখন অপরিহার্য অনুসঙ্গ। আধুনিক সমাজে ফুলের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে শুধু সৌখিনতা নয়, ফুল এখন বিরাট এক অথর্করী ফসল। ফুলের চাহিদার কমতি নেই বিশ্বজুড়ে। নতুন বছরের হালখাতা, নিবার্চন আর ইংরেজি নববর্ষ ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে জমে উঠেছে ফুলের ব্যবসা। প্রতি বছর দেশে ফুলের চাহিদা বাড়ছে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই চার মাস ফুলের ব্যাপক চাহিদা থাকে। বিভিন্ন উৎসবের কারণে বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলের চাহিদা থাকে আকাশচুম্বী। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত উৎসব, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে এই সময়ে সারা দেশে ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। এছাড়াও বছরজুড়ে বিভিন্ন উৎসব বিশেষ করে জন্মদিন, বিয়ে, কুলখানি, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা বছরজুড়ে ফুল বাণিজ্য চলে। এতে প্রতি বছর দেশে এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হয়। দেশে মোট ফুলের চাহিদার ৯৫ শতাংশ পূরণ করা হয় দেশীয় ফুল দিয়ে। বিভিন্ন ফুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। রাজধানীর শাহবাগের বিভিন্ন ফুল ব্যবসাযীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ২০ শতাংশ হারে দেশে ফুল উৎপাদন বাড়ছে। একটি জেলা থেকে ফুল উৎপাদন শুরু হলেও বর্তমানে ২৪টি জেলায় ফুল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয় যশোর জেলার গদখালি, ঝিকরগাছা, আনিসারা, কালিহাতপুর, কালীগঞ্জ। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা, নারায়ণগঞ্জের সাবদি বন্দর, গাজীপুর, ব্রহ্মণবাড়িয়া, মানিকগঞ্জের সিঙ্গার, সাভাবের গোলাপ গ্রাম ফুল চাষ হচ্ছে। এই ফুলগুলো দেশের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে বিভিন্ন ধরনের অর্কিড, লিলি ফুল, চাইনিজ জিপজি এই ধরনের কিছু ফুল দেশে চাষ হচ্ছে না। ফলে এই ধরনের কয়েকটি ফুল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে দেশের অভ্যান্তরীণ বাজারে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাড়িযেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। আগে অনেক বেশি ফুল আমদানি হলেও বর্তমানে তা কমে আসছে। বিশেষ করে ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার মতো ফুল আমদানি হতো। বর্তমানে তা কমে বছরে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ফুল আমদানি হয়। এক সময় দেশের চাহিদার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ফুল আমদানি করা হতো বর্তমানে তা কমে ৫ থেকে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এদিকে দেশের ফুল কারিগররা ফুল শিল্পকে বিকশিত করার চেষ্টা করছে। উন্নত বিশ্বে যেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ফুলের বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ফুল কারিগররা দেখে দেখে ফুল ব্যবসা শিখছে। তারপরেও আমাদের ফুলের মান খারাপ না। তবে বর্তমানে কর্পোরেট কালচারের বিকাশের কারণে ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে বেশ কিছু ইভেন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গড়ে উঠেছে। যারা কৃত্রিম ফুল দিয়ে বিভিন্ন হোটেল রেষ্টুরেন্টসহ বড় বড় অনুষ্ঠান সাজানোর কন্টাক্ট নিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে কাঁচা ফুল ব্যবসা কিছুটা ঝুঁকের মুখে পড়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা কুত্রিম ফুল আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে বর্তমানে ফুল বাণিজ্য বিকশিত করতে এবং শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শাহবাগ ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ীদের ৪০টি স্থায়ী দোকান করে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে ৮টি থেকে ৯টি দোকান করার পর বাকি কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছেন শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীরা। জমিতে খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসলের তুলনায় ফুল চাষ বেশি লাভজনক। বর্তমানে পৃথিবীর ২০টি দেশে বাংলাদেশের ফুল রপ্তানি হচ্ছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২ হাজার ৫০০ একর জমিতে ফুলের চাষ হতো, যা ২০১৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪৩ একরে। ২০১৭ সালে যা প্রায় ৪ হাজার একর হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি বাবুল প্রসাদ বলেন, বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফুলের মৌসুম। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বসন্ত উৎসব, বিশ্ব ভালোবাসা। পরপর তিন-চারটি বড় উৎসব থাকায় বছরজুড়ে মোট ফুল বিক্রির ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বিক্রি হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। আমরা হিসাব করে দেখেছি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, পহেলা লা ফালগুন সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। আর বছর হিসাবে অভ্যান্তরীন বাজারে প্রতি বছর এক হাজার ২০০ কোটি থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা।