এক টাকার শিক্ষা

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সাড়ে তিনশ’ বছর আগে শায়েস্তা খাঁর আমলে ১ টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। আর এখন? বর্তমান বাজারমূল্যে ১ টাকায় ছোট্ট চকলেট পাওয়াও খানিকটা কষ্টসাধ্যই বটে। টাকার মান কমে যাওয়ায় এক টাকার মূল্য হয়তো কমেছে; কিন্তু এই ১ টাকাই যদি শিক্ষার আলো জ্বালাতে পারে, তাহলে কেমন হয়? এক টাকায় দেশজুড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ২০১৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে ‘এক টাকায় শিক্ষা’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী শিক্ষাকে সমাজের সর্বস্তরে উন্মুক্ত করতে শুরু করে এই কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত মোহাম্মদ রিজুয়ান বর্তমানে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও চট্টগ্রাম শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার পথে ফিরিয়ে আনতে শুরু করা হয়েছিল এক টাকায় শিক্ষার কর্মযজ্ঞ। পরিকল্পনার কথা বন্ধুদের জানালে তারাও সানন্দে রাজি হয়ে যায়। অতঃপর ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এক টাকায় শিক্ষা। কিন্তু উদ্যোগ শুরু করলেই তো চলবে না, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন অর্থ। প্রথম অবস্থায় ঠিক করলেন নিজেরাই প্রতিদিন এক টাকা করে জমা রাখবেন। কিন্তু ২২ জনের অর্থে পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করা ছিল কার্যত অসম্ভব ব্যাপার।’ বিন্দু থেকে সিন্ধু’ কথাটিতে প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন রিজুয়ান। তাই এই উদ্যোগ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সবার মধ্যে। রিজুয়ানের ভাবনা, প্রতিদিন যদি ১০০ জনও ১ টাকা করে দেয় তবে তা মাস শেষে ৩ হাজার টাকায় দাঁড়াবে। আর এই উদ্যোগে প্রতিদিন ১ হাজার মানুষকে যুক্ত করতে পারলে দিন শেষে হাজার টাকা এবং মাস শেষে ৩০ হাজার টাকা তারা সংগ্রহ করতে পারবে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের ষোলশহরের রেলস্টেশন এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল এক টাকায় শিক্ষার কার্যক্রম। এরপর থেকে এক টাকায় শিক্ষার চলার পথ আর থেমে থাকেনি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশাপাশি প্রতিবছর ঈদ ইভেন্ট, শীত বস্ত্র ইভেন্ট, ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে সংগঠনটি। এর মধ্যে এক টাকায় শিক্ষা ২০২০ সালে সম্পন্ন করে রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টক কোম্পানিস অ্যান্ড ফার্মের অধীনে রেজিস্ট্রেশনের কাজ। ২০২১ সালে নতুন মোড় আসে সংগঠনের কার্যক্রমে। নিজেদের প্রতিপাদ্যকে স্মরণে রেখে তারা বিকাশের সাবস্ক্রিপশন মেথডের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদানের বিষয়টি এক টাকায় শিক্ষার ওয়েবসাইটে অটোমেটেড করে দেয়। এর মাধ্যমে কে কত টাকা দিয়েছে এবং সর্বশেষ কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত থাকছে। যে কেউ চাইলেই ওয়েবসাইটে চোখ বুলিয়ে দেখতে পারবেন তাদের লেনদেনের আদ্যোপান্ত। ২২ জন থেকে শুরু হওয়া ‘এক টাকায় শিক্ষা’ সংগঠনে বর্তমানে ১২ শতাধিক শুভাকাক্সক্ষী যুক্ত আছেন। যারা নিয়ম করে প্রতি মাসে সংগঠনে অর্থ প্রদান করে থাকেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হলেও পরিধি বড় হওয়ার পর ক্লাস নেওয়ার জন্য দুজন ক্লাসরুম ইনচার্জ যুক্ত হয়েছেন তাদের সঙ্গে। যাদের প্রতিমাসে সম্মানি দেওয়া হয়। এক টাকায় শিক্ষা কোন শিক্ষার্থীকে কত টাকা দিয়ে সহায়তা করেছে তার হিসাবও ওয়েবসাইটে গেলে পাওয়া যাবে। বিগত ৬ বছরে সংগঠনটি স্কুলকেন্দ্রিক ৫০টির মতো ইভেন্টের আয়োজন করেছে এবং ৫ হাজার ৫০০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে সহায়তা করেছে। তাছাড়া চট্টগ্রামের পাশাপাশি কক্সবাজারের একটি স্কুলে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে ৬০০ টাকা থেকে ২৪০০ টাকা পর্যন্ত বৃত্তি প্রদানের কাজও তারা করে থাকে। এক টাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে গেছে চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে বাংলাদেশের আরো ৫টি জেলায়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাহায্যের লক্ষ্যে এক টাকায় আলোকিত ফেনী, এক টাকায় আলোকিত বরিশাল, এক টাকায় আলোকিত পটুয়াখালী, এক টাকায় আলোকিত কক্সবাজার এবং এক টাকায় আলোকিত নোয়াখালী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারা। কাজের পরিচালনা চট্টগ্রাম থেকে হলেও দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় চালিয়ে যাচ্ছে কর্মকাণ্ড। এক টাকায় শিক্ষা কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ২০২০ সালে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে এই সংগঠনটি। তাছাড়া ২০২৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ডায়না অ্যাওয়ার্ডও আসে এক টাকায় শিক্ষার ঝুলিতে।