২০৪১ সালের মধ্যে ৫.৫৭ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নিয়ে বহুল প্রত্যাশিত পর্যটন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড (বিটিবি)। একইসঙ্গে, এই খাতে ২১.৯৪ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন প্রণয়নকৃত পরিকল্পনায় ১০টি পর্যটন ক্লাস্টার তৈরির জন্য ১.০৮ বিলিয়ন ডলার সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের তথ্য মতে, বর্তমানে এর জন্য পাঁচটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা চলছে।
এছাড়া সরকার রাস্তা, বিদ্যুৎ এবং নিরাপত্তার মতো অবকাঠামোগত সুবিধা উন্নয়নে ১০৫.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। অন্যদিকে, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা মূলত বিনিয়োগ করবে তারকা হোটেল, রিসোর্ট, বিনোদন পার্কসহ অন্যান্য বিলাসবহুল সুবিধা নির্মাণে। শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, মহাপরিকল্পনাটি বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি বিস্তৃত রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে।
পর্যটন খাতে উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। মূলত এই ঘটতি কাটিয়ে উঠতেই এই মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ। দুর্বল পর্যটন অবকাঠামো, জটিল ভিসা পদ্ধতি, খাদ্য অভিযোজনে সমস্যা, বিনোদনের অভাব, সামাজিক বিধিনিষেধ, অপর্যাপ্ত সরাসরি ফ্লাইট এবং সুবিধাজনক পরিবহণব্যবস্থার অভাবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম বলে মনে করেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। গত বছর দেশ-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন প্রায় ৫.২২ লাখ মানুষ। অন্যদিকে, ভারতে এই সংখ্যা ছিল ৬.১৯ মিলিয়ন, শ্রীলঙ্কায় ৭.১৯ লাখ এবং নেপাল ছিল ৬.১৪ লাখ। মহাপরিকল্পনায় সারাদেশে ১, ৪৯৮টি ট্যুরিজম রিসোর্স বা পর্যটন সম্পদ চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া, মার্কেট পোটেনশিয়াল বা বাজার সম্ভাবনা, স্বতন্ত্রতা, সম্পদের প্রাপ্যতা এবং স্থায়িত্বের ভিত্তিতে এগুলোকে ১৪টি থিমে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সূত্র জানায়, দেশে ভ্রমণ ও আতিথেয়তা খাতে প্রায় ৫০ লাখ লোক কর্মরত রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার, সুন্দরবনের শরণখোলা এবং পদ্মা সেতুর পাশের মাওয়ায় মহাপরিকল্পনার আওতায় পাঁচটি পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে শিগগিরই।
প্রিপারেশন অব ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান ফর বাংলাদেশের প্রকল্প সমন্বয়ক সাক্ষী গোদারা বলেন, ‘সরকার যখন ওই ১০ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে, তখন এক বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে এই খাতে। পাশাপাশি, বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার সামগ্রিক কৌশল এবং পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে এই মহাপরিকলনায়, যা আরো কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে।’ ভারতে আন্তর্জাতিক পর্যটন পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবাল বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের জন্য এই পরিকল্পনা তৈরি করেছে। পরিকল্পনাটি তৈরিতে মোট ব্যয় হয়েছে ২৮ কোটি টাকা। মহাপরিকল্পনার এই খসড়াটি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে, শেষ হয়েছে চলতি ২০২৩ সালের জুনে।
বিটিবি সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় পর্যটন কাউন্সিল (এনটিসি) পরবর্তী বৈঠকেই পরিকল্পনাটি অনুমোদন করতে পারে।
কর্মকর্তারা জানান, এই মাস্টারপ্ল্যান একটি দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ, যার মধ্যে অনেক ছোট ছোট ও বিস্তারিত পদক্ষেপের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। ব্যাপক উন্নয়ন ও দেশকে আন্তর্জাতিক পর্যটন বিশ্বে অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই এই মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ। পরিকল্পনায় বর্ণিত বড় আকারের প্রকল্প ও উদ্যোগগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য ধারাবাহিক ও পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মো. জাবের। বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে, বিটিবি ইতোমধ্যেই দেশের পর্যটন আকর্ষণগুলোর প্রচার-প্রচারণায় মনোযোগ দিয়েছে। এই উদ্যোগকে আরো বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতি প্রণয়নও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মো. জাবের বলেন, ‘আমরা পর্যটন সম্ভাবনাকে নির্ধারণ করে সেখানে ট্যুরিস্ট এবং বিনিয়োগকরীদের জন্য যেসব সুবিধা দরকার, তা তৈরি করে দেব। এর পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা কোথায় হোটেল, রিসোর্ট- এগুলো নির্মাণ করবেন সেসব স্থানও নির্ধারণ করে দেব।’
মহাপরিকল্পনার মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ক্রমাগত আমাদের পর্যটন খাত কীভাবে বিকশিত হবে, তার রোডম্যাপ হলো এই মাস্টারপ্ল্যান। এর ভেতরে প্রত্যেক বিভাগভিত্তিক রিজিওনাল প্ল্যানও রয়েছে।’ এখানে রয়েছে মার্কেটিং, ইনভেস্টমেন্ট এবং অ্যাকশন প্ল্যান।