ঢাকা ১২ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ডলারের প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ

রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকারের বহুমুখী সিদ্ধান্ত

রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকারের বহুমুখী সিদ্ধান্ত

বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বহুমুখী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ডলার আয় উৎসাহিত করতে ও খরচের লাগাম টানতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করছে। কিন্তু বাস্তবে এর তেমন একটা সুফল মিলছে না। উল্টো নানা ধরনের গুজব রটে বাজারে আস্থার সংকটকে আরো প্রকট করে তুলছে। এতে ডলারের দাম বেড়ে টাকার মান কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে দেনা শোধ করার ধারা অব্যাহত থাকায় রিজার্ভের ক্ষয় মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। তবে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপের ফলে এখন চলতি হিসাবে ঘাটতি থেকে উত্তরণ ঘটে উদ্বৃত্ত হয়েছে। তারপরও ডলারের সংকট কাটছে না। বরং আরো প্রকট হচ্ছে। সূত্র জানায়, বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে।

এই চার খাতেই আয়ের ধারা নিম্নমুখী। এর মধ্যে রেমিট্যান্স বাড়াতে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। সংযুক্ত আরব আমিরাতে হুন্ডির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পর ওই দেশ থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এ ধরনের পদক্ষেপ দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম প্রায় ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি। ফলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ চলে যাচ্ছে হুন্ডিতে।

মানি চেঞ্জার্স ও কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করলে ওখানে ডলার লেনদেনে স্থবিরতা নেমে আসে। এখন কিছু লেনদেন হলেও দাম ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা। মানি চেঞ্জার্সগুলো নির্ধারিত দামে ডলার পাচ্ছে না বলে বিক্রিও কমে গেছে। ফলে এতে ডলারের প্রবাহ তো বাড়েইনি। উলটো কমে গেছে। ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হলে রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি জুলাই-আগস্টে কমেছে ২৮ শতাংশ ও এলসি খোলা কমেছে ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরেও এ খাতে আমদানি ও এলসি দুই-ই কমেছিল। রপ্তানির আদেশ কম আসায় কাঁচামাল আমদানি কমছে। আগামীতে রপ্তানিকারকরাও আয় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জুনে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫০৩ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা কমে ৪৫৯ কোটি ডলার, আগস্টে সামান্য বেড়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৭৮ কোটি ডলার। ৩ মাসে এসেছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বেড়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। জুনে রেমিট্যান্স এসেছিল ২২০ কোটি ডলার, জুলাইয়ে তা কমে ১৯৭ কোটি ডলার, আগস্টে তা আরো কমে ১৬০ কোটি ডলার এসেছে। ৩ মাসের হিসেবে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। ওই কমার বিপরীতে গত অর্থবছরে বেড়েছে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বেড়েছিল ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বাড়ার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদানের গতিও নিম্নমুখী। ২০২১-২২ অর্থবছরে অনুদান বেড়েছিল ৫১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে বাড়ার পরিবর্তে বরং কমেছে সাড়ে ১১ শতাংশ।

গত অর্থবছরের জুলাইয়ে বেড়েছিল ৮৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ৩৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। জুন ও জুলাইয়ে অনুদান এসেছে মাত্র ৩২ কোটি ডলার। বৈদেশিক বিনিয়োগ ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ১৮৩ কোটি ডলার, গত অর্থবছরে এসেছে ১৬১ কোটি ডলার। তবে জুলাইয়ে বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। গত বছরের ওই সময়ে ১৭ কোটি ও চলতি বছরের একই সময়ে এসেছে ১৮ কোটি ডলার। এর বিপরীতে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচের মধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পরও তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে এ খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় আরো চাপে পড়বে। জুনে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৪৭৪ কোটি ডলার, জুলাইয়ে ৬১৪ কোটি ডলার, আগস্টে ৫৬২ কোটি ডলার। ৩ মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৬১০ কোটি ডলার। ওই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার ও রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৭ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি মিলে আয় হয়েছে ২ হাজার ১৯৫ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি ব্যয় বাদ দিলে উদ্বৃত্ত থাকছে ৭৪৭ কোটি ডলার। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে গিয়ে এখন উদ্বৃত্ত হচ্ছে। জুলাইয়ে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৫৪ কোটি ডলার। বিনিয়োগ ও অনুদান থেকে যেসব ডলার আসছে তার বড় অংশ যাচ্ছে বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ও অন্যান্য খাতে। এছাড়া বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফা নেওয়া, রয়্যালটি পরিশোধ, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের অর্থ নেওয়া বাবদ আরো ডলার খরচ হচ্ছে। এর বাইরে স্থগিত ঋণ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আরো কমপক্ষে ৬০০ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। এসব মিলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক স্থিতিতে ঘাটতি হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি হয়েছিল ৬৬৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৮২২ কোটি ডলার। গত বছরের জুলাইয়ে ঘাটতি ছিল ১০৮ কোটি ডলার। চলতি বছরের একই মাসে তা কিছুটা কমে ১০৭ কোটি ডলার ঘাটতি হয়েছে। এ ঘাটতির কারণে বাজারে ডলার প্রবাহ বাড়ছে না। ডলারের দাম আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশে বাড়ানো হতো। গত বছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের চাপে ডলারের দাম বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি মাসে গড়ে ১ টাকা থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত বাড়ানো হতো। চলতি মাসে দুদফা বাড়ানো হয়েছে। ৩ সেপ্টেম্বর রুটিন মাফিক বাড়ানো হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে আরো এক দফা বাড়ানো হয়। একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগাম ডলার বেচাকেনার লাগাম টেনে ধরতে নতুন নীতি ঘোষণা করে। ফলে ডলারের আগাম বেচাকেনার ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া বাজারদরের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ বার্ষিক ভিত্তিতে যোগ করার কথা। অর্থাৎ, ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদ ও এর সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ যোগ করার কথা। বর্তমানে ট্রেজারির বিলের গড় সুদ ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত