ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

১৮ হাজার কোটি টাকার ঢেউটিনের বাজারে নতুন ঢেউটিন

১৮ হাজার কোটি টাকার ঢেউটিনের বাজারে নতুন ঢেউটিন

দুই দশক আগের কথা। ঢেউটিন বলতে ছিল জিংকের প্রলেপযুক্ত সাধারণ টিন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢেউটিনেও রঙের ছোঁয়া লাগে। তাতে শুরু হয় রং ও পুরুত্বের বৈচিত্র্য। এখন এ খাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। কারখানার ছাদে এখন সাধারণ টিনের বদলে জায়গা করে নিয়েছে নানা ধরনের ঢেউয়ের টিন বা প্রোফাইল। প্রোফাইলের পাশাপাশি জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিনসহ নতুন নতুন পণ্য যোগ হয়েছে এ তালিকায়। ইস্পাতশিল্পকে বলা হয় মাতৃশিল্প। লং স্টিলে শুধু রড, চ্যানেল ও অ্যাঙ্গেলের মতো গুটিকয় পণ্য রয়েছে। তবে ফ্ল্যাট স্টিল বা ইস্পাতের পাতশিল্প থেকে হাজারো পণ্য তৈরি হয়। যেমন ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ, ইলেকট্রনিকস, মুঠোফোন, গাড়ি, শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি তৈরি হয় ইস্পাতের পাত থেকে। দেশে চাহিদা বেশি থাকায় ইস্পাতের পাতশিল্পগুলো এখন সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করছে ঘর ও কারখানায় ব্যবহারের ঢেউটিন। এ খাতে বিনিয়োগ ও বৈচিত্র্য দুটোই বাড়ছে। ঢেউটিনে এ বৈচিত্র্য এসেছে ইস্পাতের পাতশিল্পের হাত ধরে। মূলত দেশের পাঁচ শিল্পগোষ্ঠী ঢেউটিনের বাজারে নতুন নতুন পণ্য যুক্ত করেছে। বৈচিত্র্য আনতে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ করছে তারা। তাদের দেখানো পথে নতুন প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাত ধরে এ শিল্পে আমদানি-নির্ভরতা কমছে। তাতে সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। বাড়ছে কর্মসংস্থান। ইস্পাতের মতো মৌলিক শিল্পেও দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ঢেউটিনের চাহিদা কমলেও তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই উদ্যোক্তাদের। কারণ, এ শিল্পে নতুন নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে ঢেউটিন খাতের শুরুটা হয়েছিল চিটাগাং স্টিল মিলসের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৬৭ সালে চালু হওয়া সরকারি এ কারখানায় বিলেট, লোহার পাতের পাশাপাশি ঢেউটিনও তৈরি হতো। ১৯৯৯ সালে এ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়; যদিও এর কয়েক বছর আগেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারখানাটির। বিশ্বব্যাংকের ১৯৭৬ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, দেশ স্বাধীনের পরও এ কারখানায় বছরে ৭ থেকে ৮ হাজার টন ঢেউটিন উৎপাদিত হতো। সরকারি এ কারখানার উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো যেত না; তাতে ঢেউটিন ছিল আমদানি-নির্ভরতা। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৯৭৪-৭৫ সালের বর্ষপঞ্জিতে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর প্রতি বছর ঢেউটিন আমদানি হতো। ১৯৭২-৭৩ সালে ২৯ হাজার ১৫৬ টন ঢেউটিন আমদানি হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় বেসরকারি খাত মধ্যবর্তী কাঁচামাল থেকে ঢেউটিন উৎপাদনে যুক্ত হলে আমদানি কমে আসে। নব্বইয়ের দশকে ঢেউটিনের চাহিদা বাড়তে থাকায় উদ্যোক্তারা বড় কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে ঢেউটিনের কাঁচামাল কোল্ড রোলড বা সিআর কয়েল তৈরির কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি শিল্প গ্রুপ- আবুল খায়ের, পিএইচপি, টি কে, কেডিএস এবং এস আলম বড় কারখানা চালু করে এ খাতে। পরে যুক্ত হয় আরএম এবং অ্যাপোলো ইস্পাতও, যে দুই কারখানা এখন বন্ধ। এসব কারখানা অপরিশোধিত ইস্পাত পাতের কয়েল আমদানি করে, সেখান থেকে ঢেউটিনের কাঁচামাল পরিশোধিত ইস্পাতের পাত তৈরি করত। বড় বড় শিল্প গ্রুপের বিশাল বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এসব কারখানা ঢেউটিন খাতে নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসে। উৎপাদনে যুক্ত হয় স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া। রঙিন ঢেউটিন তৈরির মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ খাতে পণ্যের বৈচিত্র্য।

শুরুতে জিংকের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিন উৎপাদিত হলেও পরে চালু হয় জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিন। আবার ইস্পাতের কাঠামোর কারখানা নির্মাণে বড় বড় ঢেউয়ের টিন বা প্রোফাইলও উৎপাদন শুরু করে বড় উদ্যোক্তারা। অপরিশোধিত ইস্পাতের পাত থেকে ঢেউটিন তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলত আবুল খায়ের ও পিএইচপি গ্রুপ। এ দুই গ্রুপের হাতেই মোট বাজারের ৭৫ শতাংশ অংশীদারত্ব। কেডিএস গ্রুপের কেওয়াইসিআর কয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ১৪ শতাংশ, টিকে গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপের হাতে ৫ শতাংশ করে বাজার অংশীদারত্ব রয়েছে। একসময় শুধু ঘরের চাল ও চার পাশে বেড়ার কাজে ব্যবহার করা হতো ঢেউটিন। গ্রামেগঞ্জে ছিল চাহিদা। এখন গ্রাম ছাড়িয়ে শহরেও চাহিদা বাড়ছে ঢেউটিনের। মেট্রোরেল, উড়ালসড়ক, টানেলের মতো প্রকল্প এলাকায় প্রকল্পের চারপাশ ঘেরাও করার জন্য দরকার হয় ঢেউটিন। নতুন করে বড় চাহিদা তৈরি হচ্ছে কারখানা ও শেড স্থাপনে। দ্রুত নির্মাণের জন্য ইস্পাতের কাঠামো ব্যবহৃত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। এসব কারখানায় ছাদ ও চারপাশ ঘেরাও করার জন্য দরকার শিল্পের ঢেউটিন বা প্রোফাইল। পণ্যের বহুমুখীকরণের কারণে বাজারও বড় হচ্ছে। বিশ্ববাজারে ঢেউটিনশিল্পের কাঁচামাল পরিশোধিত-অপরিশোধিত ইস্পাত পাতের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। কাঁচামাল আমদানির হিসাবে বছরে ১১ থেকে ১২ লাখ টন ঢেউটিন ও ঢেউটিনের সহযোগী পণ্য উৎপাদন করা হয়। উদ্যোক্তাদের হিসাবে এ খাতে বছরে বার্ষিক বেচাকেনা এখন ১৮ হাজার কোটি টাকা। একসময় ঢেউটিন রপ্তানি হতো। স্থানীয় চাহিদা বাড়ায় এখন রপ্তানি কমে এসেছে। এরপরও প্রতিবেশী দেশগুলোয় কিছু ঢেউটিন রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে কেডিএস গ্রুপ। গত অর্থবছরে কেডিএস গ্রুপের কেওয়াইসিআর কয়েল ইন্ডাস্ট্রি ভারত ও সেন্ট বার্থেলামিতে ৮২ লাখ ৫৫ হাজার ডলারের ইস্পাতের পাতসহ ঢেউটিনপণ্য রপ্তানি করেছে। ঢেউটিন ছাড়িয়ে ইস্পাতের পাতশিল্পের পণ্য ব্যবহারের চাহিদা তৈরি হওয়ায় কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ বাড়ছে এ খাতে। রঙিন ঢেউটিনগুলোয় বাড়তি প্রলেপ বা প্রতিরক্ষামূলক আবরণ থাকায় ঘরবাড়ি, কারখানা ও অন্যান্য কাঠামোর ছাদ বা আচ্ছাদন হিসেবে এগুলোর ব্যবহার বাড়ছে। সে হিসেবে দেশে ঢেউটিনের বার্ষিক চাহিদা এখন ১২ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার বাজার। তবে বর্তমানে দেশে মাত্র ৫ প্রতিষ্ঠান ঢেউটিন তৈরি করছে। এর সবগুলোই চট্টগ্রামে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো পিএইচপি ফ্যামিলি, কেডিএস গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ ও টিকে গ্রুপ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবুল খায়ের ও পিএইচপি যৌথভাবে বাজারের ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের মতে, বাজারে কেডিএসের ঢেউটিনের চাহিদা প্রায় ১৫ শতাংশ এবং টিকে গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের ঢেউটিনের চাহিদা ৫ শতাংশ করে। ১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চিটাগাং স্টিল মিলস চালু হলে বাংলাদেশে ইস্পাত শিল্পের সূচনা হয়। এই ইস্পাত বিলেট, লোহার শিট ও ঢেউটিন তৈরির কারখানাটি দেশের সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে না পারায় সে সময় এর বাজার আমদানি-নির্ভর ছিল। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমদানি কমতে শুরু করে।

আমদানি করা ঢেউটিনগুলো মূলত জাপান, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসে। তবে, দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সস্তায় ঢেউটিন দেওয়ায় আমদানি ধীরে ধীরে কমছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত