দেশে ধান উৎপাদনে নতুন রেকর্ড
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি টান হাবিবুর রহমান জালালের (৪৩)। চারপাশের সবুজ ও সোনালি ফসলেই তার বাঁচা। একসময় জীবিকার সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তবে কয়েক বছর থেকে স্থায়ীভাবে দেশে আছেন এবং কৃষিতেই মজে আছেন। নতুন জাতের ধান চাষেই তার আগ্রহ ও আনন্দ। অন্যরা যেখানে নতুন জাতের ধান চাষ নিয়ে সংশয়ে থাকেন, সেখানে তিনি সানন্দে নতুন জাতের ধান চাষে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। হাবিবুর রহমানের বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগরে। বর্তমানে তার সময় কাটে কৃষির নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার ও নতুন জাত নিয়ে কাজ করে। লাভণ্ডক্ষতির কথা না ভেবেই গবেষকের মতো তিনি নতুন জাতের ধান চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। চাষাবাদ তার জীবিকার উৎস হলেও কৃষিতে নতুন কিছু খুঁজতেই তার আনন্দ। খেত আলো করে থাকা সোনালি আউশ ধান কেটে ঘরে তোলার মৌসুম চলছে। সিলেটের খেতগুলো পাকা ধানের গন্ধে মেতে উঠেছে। খেতে খেতে কৃষকের ব্যস্ততা সীমাহীন। কেউ পাকা ধান কাটছেন, কেউবা মাড়াইয়ে ব্যস্ত। ছোট-বড় অনেকে মিলে সেই ধান ঘরে তুলছেন। ১১ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে গিয়াসনগরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের ধানখেত চোখে পড়ে। ধানখেত গাঢ় কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ধানের পাতায় ও শীষে জমে আছে শিশির। একটি খেতে পাতার আড়ালে উঁকি দেওয়া বেগুনি রঙের ধানে পাক ধরছে। সেখানে টাঙানো সাইনবোর্ডে লিখা ‘কোরিয়ান বেগুনি ধান’। অন্য খেতগুলোতে রঙিন ফিতা টানানো। বিভিন্ন ধরনের রঙিন বেলুন বাতাসে কাঁপছে। দেখে মনে হয় কোনো উৎসবের প্রাঙ্গণ। ধানখেত দেখতে দেখতেই কৃষক হাবিবুর রহমান বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ট্রাকস্যুট, রেইনকোট ও মাথায় গোল টুপি পরা। দেখতে অনেকটা ভিনদেশি চাষির মতো। তার সঙ্গে মাঠে ঢুকতেই একটি খেতে ‘ইন্দোনেশিয়ান কালো ধান’, একটি খেতে লেখা ‘ফাতেমা ধান-২’ সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ থেকে তিনি রঙিন ধান চাষ করছেন। এ জাতের ধান চাষে তার আগ্রহ তৈরি হয়েছে অনলাইনে দেখে। বীজও সংগ্রহ করেছেন অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন চাষির কাছ থেকে। গত বছর দেশি-বিদেশি ১২ জাতের ধান চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার ধান ছিল। এই পাঁচ জাতের সব ক’টি চাল কালো, নয়তো কালোর মতো। সব ক’টি জাতই ১০ থেকে ১৫ শতক করে জায়গাতে চাষ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ চলতি মাসে বিশ্বের দানাদার খাদ্যের বৈশ্বিক উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ বছর উৎপাদন হতে পারে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টন চাল। ভালো আবহাওয়া ও কৃষক ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় এই উৎপাদন বেড়েছে, যা বিশ্বের প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। কৃষকরা স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল জাত (উফশী) ও হাইব্রিড ধান চাষ করায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে টানা ষষ্ঠবারের মতো ধানের উৎপাদন বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বোরো উৎপাদনের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে ২ কোটি সাত লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। এটি এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) সাবেক মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘দেশে আধুনিক সরঞ্জাম ও নতুন জাতের বীজের ব্যবহার বেড়েছে। কৃষকরা আরো ভালোভাবে খেত প্রস্তুত করছেন। সরকার নন-ইউরিয়া সারে ভর্তুকি দেওয়ায় সার ব্যবহার সুষম হচ্ছে।’ তার মতে, সামগ্রিকভাবে মাঠ পর্যবেক্ষণ নিবিড় হয়েছে। কৃষক তাদের পরিবারের জন্য সারা বছরের খাবার নিশ্চিত ও বাড়তি অংশ বিক্রি করে উপার্জনের আশায় ফসল উৎপাদনে আরো যত্নবান হয়েছেন। সাত বছর আগে বাংলাদেশে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ফসল উৎপাদন সামগ্রিকভাবে বেড়েছে। ধানি জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আধুনিক জাতের ফসল ফলানোয় চাল আমদানি কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করেছিল। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় সামান্য বেশি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গত ১ জুলাই থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত চাল আমদানি হয়নি। বিশ্লেষকদের বলছেন, গত অর্থবছরে উৎপাদন বেশি হওয়ায় চাল আমদানির প্রয়োজন হয়নি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে ডলার ঘাটতির কারণে রিজার্ভ যখন চাপে আছে তখন ফলন বেশি হওয়ায় চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তা কমেছে। তিনি আরো বলেন, ‘ফলন বেশি হওয়ায় শস্য আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার বাড়তি প্রয়োজন কমেছে। ডলার ঘাটতির কারণে যদি চাল আমদানি কমে যেত তাহলে দেশের বাজারে চালের দাম বেড়ে যেত। এতে দরিদ্র মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়ত। চালের দাম স্থিতিশীল থাকায় আমি খুশি, উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। কৃষিতে সরকারের মনোযোগের কারণে চালের উৎপাদন বেড়েছে। বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট ধানি জমির ৮১ শতাংশে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ছিল ৭৩ শতাংশ। অন্যদিকে, উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় জাতের তুলনায় বেশি ফলন দেওয়া হাইব্রিড ধানের চাষ ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে, স্থানীয় জাতের ধান চাষ অর্ধেক কমেছে। এখন স্থানীয় জাতের ধান চাষ হচ্ছে মোট ধানি জমির প্রায় ৯ শতাংশ এলাকায়। বিআরআরআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস মনে করেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য শস্য বিমার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে। তার মতে, কৃষি গবেষণায় সরকারের মনোযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষি বিজ্ঞানীদেরও উৎসাহ দিতে হবে। এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাবারের বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিআরআরআই ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছে। দেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। বাকৃবি অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম দেশের চাহিদা মেটাতে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর না করে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের উৎপাদন ও এর প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হবে। এজন্য সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ আমদানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।