শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হচ্ছে জাতীয় মজুরি নীতি
নিম্নতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ধারিত মানদ- তৈরির লক্ষ্যে দেশে প্রথমবারের মতো হতে যাচ্ছে ন্যাশনাল ওয়েজ পলিসি তথা জাতীয় মজুরি নীতি। দেশে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের আওতায় থাকা ৪৪টি খাতের পাশাপাশি কৃষি, পরিবহণ শ্রমিক, বাসাবাড়িতে কাজ করা সব ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাও এর আওতায় আসবে। এ পলিসি বাস্তবায়ন শুরু হলে দেশের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি, পরিবারের ব্যয়, প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা- এসব বিবেচনায় নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। এই পলিসি নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক নেতারা বলছেন, পলিসিটি বাস্তবায়ন হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে যারা এখন উপেক্ষিত কিংবা কম মজুরি পান, তাদের মজুরি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রায় ৬ মাস আগে ন্যাশনাল লেবার পলিসি করার উদ্যোগ নেয়। .এরইমধ্যে একাধিক সভা শেষে মন্ত্রণালয় একটি খসড়াও তৈরি করেছে। তবে এখনো শ্রমিকপক্ষ তাদের খসড়া প্রস্তাবনা জমা দেয়নি। শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা চাইছেন আলোচ্য পলিসির আওতায় ন্যূনতম মজুরির বিষয়টিও যুক্ত করতে। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব এবং জাতীয় মজুরি নীতি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, আমরা শ্রমিকদের পক্ষ থেকে একটি ড্রাফট তৈরি করছি। শিগগিরই এই ড্রাফট জমা দেব।
আমরা চেষ্টা করব ন্যাশনাল ওয়েজ পলিসিতে যাতে মিনিমাম ওয়েজ পলিসি যুক্ত করা হয় এবং শ্রমিকরা যাতে বাঁচার মতো মজুরি পায়, বলেন তিনি। মিনিমাম ওয়েজ পলিসি যুক্ত হলে শ্রমিকদের কী লাভ হবে, এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বর্তমানে এই পলিসি না থাকায় মিনিমাম ওয়েজ বোর্ড মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একেক খাতের জন্য একেক রকম মজুরি নির্ধারণ করছে। কোন খাতের কম ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হওয়া উচিত- তা উপেক্ষিত থাকছে। কিন্তু মিনিমাম ওয়েজ পলিসি থাকলে এর ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে এবং ওই মজুরির নিচে কোনো খাত মজুরি নির্ধারণ করতে পারবে না। এর ফলে শ্রমিকদের মজুরির ক্ষেত্রে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসবে, বলেন তিনি। এই কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নভেম্বরের মধ্যে এই ড্রাফট তৈরি হবে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামত নেওয়ার পর আগামী বছর নাগাদ তা চূড়ান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো ধরনের মজুরি নীতি নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ ২০১৭ সালের লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটির বেশি।
এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মজুরি কাঠামো নেই। এছাড়া প্রায় এক কোটি শ্রমিক আছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। প্রতিষ্ঠাানিক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে ৪৪টি খাতের শ্রমিকদের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মিনিমাম মজুরি বোর্ড কর্তৃক মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন কোন খাত আছে যেখানে ১৯৮৭ সালের পর আর নতুন মজুরি নির্ধারন করা হয়নি। মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি ১৯৮৭ সালের পর আর নির্ধারণ হয়নি, এবং এই মজুরির পরিমাণ মাসে মাত্র ৭৯২ টাকা। অবশ্য মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আলোচ্য খাতসহ ১৫টি খাতের নতুন মজুরি নির্ধারণের কাজ বর্তমানে চলমান। মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের সচিব ও জাতীয় মজুরি নীতি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য রাইসা আফরোজ বলেন, নতুন পলিসি বাস্তবায়ন হলে মজুরি নির্ধারণের কিছু অসঙ্গতি কমে আসবে। মন্ত্রণালয় একটি খসড়া তৈরি করেছে বলে জানান তিনি।
মালিকপক্ষের নিম্নতম মজুরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান শ্রমিকনেতাদের :
শ্রমিকের মজুরি ইস্যুতে পোশাক খাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি)। তারা পোশাক শ্রমিকের জন্য নিম্নতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে সংগঠনটি বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে কারখানার উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানায়। রাজধানীর তোপখানায় জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গত শুক্রবার সকালে আইবিসির জরুরি সভা শেষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
আইবিসির সভাপতি আমিরুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে আইবিসির অধীনে ১৮টি রেজিস্টার্ড ফেডারেশন রয়েছে। মালিকপক্ষের ১০, ৪০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানান শ্রমিকনেতারা। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য ২৩ হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি, ৬৫ শতাংশ মূল মজুরি, বছরে ১০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি এবং সাতটির পরিবর্তে পাঁচটি গ্রেড দাবি করেছে আইবিসি। একই সঙ্গে সংগঠনটি বলেছে, তারা কোনোভাবেই আইবিসি কারখানা ভাঙচুর, ইচ্ছামাফিক কাজ বন্ধ, যখন-তখন রাস্তা অবরোধ সমর্থন করে না।
আইবিসি বলেছে, অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে সহায়তা করবে না; বরং ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এছাড়া অনেক জায়গায় মালিকরা তাদের ভাড়াটে মাস্তানবাহিনী দিয়ে শ্রমিকদের ওপর হামলা চালানোরও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আইবিসি। নিম্নতম মজুরি বোর্ডের গত রোববারের সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি নিম্নতম মজুরি প্রস্তাব করেন ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা। অন্যদিকে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে নিম্নতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা করার প্রস্তাব দেন। প্রত্যাশার চেয়ে মালিকপক্ষ অনেক কম মজুরি প্রস্তাব করায় গত সোমবার থেকে তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা চার দিন গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা সর্বনিম্ন ২৩ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে বিক্ষোভণ্ডমিছিল কর্মসূচি পালন করেছেন। আন্দোলনরত শ্রমিকরা গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন। ভাঙচুর করেছেন অর্ধশত গাড়ি। পুলিশের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা।
মালিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাব : বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি গত শুক্রবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে মালিকপক্ষের দেওয়া ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।
তারা বলেছেন, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট (বৃদ্ধি) ও মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে বর্তমানে একজন শ্রমিকের মজুরি এমনিতেই ১১ হাজার টাকা হওয়ার কথা। সমাবেশে শ্রমিক নেতারা বলেন, ২৫ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব বিবেচনায় এনে অতি দ্রুত নতুন মজুরি কাঠামো চূড়ান্ত করতে হবে। তা না হলে শুধু গাজীপুর না অন্যান্য অঞ্চলের শ্রমিকরাও বিক্ষুব্ধ হবেন। সংগঠনটির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতারের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন এর সহ-সভাপ্রধান অঞ্জন রায়, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গার্মেন্ট টিইউসির সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেন প্রমুখ। সমাবেশে শ্রমিক নেতারা বলেন, বর্তমান বাজার বিবেচনায় শ্রমিকরা চলার মতো অবস্থায় নেই। পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকার উপরে, আলু ৭০ টাকা। এভাবে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম শ্রমিকের নাগালের বাইরে। এ সময় মালিকের সুবিধামতো মজুরি প্রস্তাব এবং নতুন মজুরি ঘোষণায় বিলম্ব শ্রমিকদের প্রতি দায়িত্বহীনতারই পরিচয়। তারা বলেন, জাতীয় রাজনীতির জটিল পরিবেশে ইচ্ছামতো লামসাম মজুরি ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা তা গ্রহণ করবেন না।