ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধু টানেল : অর্থনৈতিক করিডোরে নতুন সূচনা

বঙ্গবন্ধু টানেল : অর্থনৈতিক করিডোরে নতুন সূচনা

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের চিরচেনা রূপ। যোগাযোগ খাতে সাফল্যের সেই মুকুটে যুক্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। প্রকল্প পরিচালক বলছেন, টানেল ব্যবহারে গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্টে (জিডিপি) শূন্য দশমিক এক ছয় ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। উন্নয়নের পালকে এবার যুক্ত হচ্ছে, খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তিন দশমিক তিন দুই কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। একের পর এক মেগা প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশের চিরচেনা ল্যান্ডস্কেপ। যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বেড়েছে দেশের সক্ষমতা ও সামর্থ্য। বিদেশেও প্রশংসিত হচ্ছে এসব মেগাপ্রকল্প। দেশের সড়ক যোগাযোগে নতুন যুগের সূচনা করেছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এ টানেলটি মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডকে অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তরিত করবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীরা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের দুই অঞ্চলকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর পর তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার টানেল সড়ক পরিবহন খাতে দ্বিতীয় ‘ড্রিম প্রজেক্ট’। চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেল অনুসরণ করে টানেলটি তৈরি করা হয়েছে। টানেলটি কর্ণফুলীর উত্তর প্রান্তে চট্টগ্রাম বন্দরনগরীকে নদীর দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানেলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ এর দুই পাশের দুই বড় অর্থনৈতিক করিডোরকে যুক্ত করে চট্টগ্রামকে বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে কাজ করবে। ভবিষ্যতে এ টানেল এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের উন্নতি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগাযোগ জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলটি উদ্বোধন করেন। গতকাল রোববার এটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। টানেলটি দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানাগুলোয় ব্যবহৃত ও উৎপাদিত কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ সাশ্রয় করবে। এই জোনে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, কর্ণফুলী উপজেলায় কোরিয়ান ইপিজেড, আনোয়ারা উপজেলায় চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন ও কক্সবাজার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটিতে চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে। বেইজিং দুই শতাংশ সুদে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। কর্ণফুলীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি টানেলটি তৈরি করেছে। মূল টানেলটি তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রতিটি টিউবে দুই লেনসহ-এর দুইটি টিউবের দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে পাঁচ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার ফ্লাইওভার আছে। উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্যে জানা যায়- বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, পোশাক, জাহাজ নির্মাণ, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ইস্পাত, সিমেন্ট ও তেল শোধনাগারসহ বেশ কয়েকটি খাতে কারখানা স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে অন্তত ৫০ বড় শিল্পগোষ্ঠী ও ৩৫০ ব্যবসায়ী জমি কিনেছেন। অন্তত শতাধিক কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে বলেও জানান বিনিয়োগকারীরা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের পাশাপাশি কর্ণফুলী টানেল এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, টানেলটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে।’ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ও বন্দরনগরী থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে মিরসরাইয়ে ৩৩ হাজার ৮০৫ একর জমির ওপর গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। এটি উপকূল বরাবর মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে টানেলের সঙ্গে যুক্ত হবে। মেরিন ড্রাইভটি পরবর্তীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এটি সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এ এলাকার শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করবে। গত ১১ অক্টোবর বেপজার প্রতিবেদনে জানা যায়, মিরসরাই অর্থনীতিক অঞ্চলে ১৫২ প্রতিষ্ঠানকে ৫ হাজার ২৭১ দশমিক ৪৭ একর জমি ইজারা দেওয়ার ?চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ প্রতিষ্ঠান ৪১০ একর জমিতে কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি এক দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এরই মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫২ হাজার ২৩৮ জনের। ইজারা চুক্তির মাধ্যমে নিবন্ধিত ১৫২ প্রতিষ্ঠানের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার ও কর্মসংস্থান হবে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ২২৮ জনের।

২০৩০ সালের মধ্যে এই জোনে ৫৩৯ প্লট বরাদ্দ শেষে ?উৎপাদনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে মোট বিনিয়োগ আরো কয়েকগুণ বাড়বে। সরাসরি কর্মস্থান হবে ১৫ লাখের বেশি মানুষের। এ ছাড়া কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাশে আড়াই হাজার একর জমিতে কোরিয়ান ইপিজেডের ৩৮ কারখানা এ টানেলের সুবিধা পাবে। এখন কোরিয়ান ইপিজেড প্রতি বছর দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। যদিও এখনো এই ইপিজেডের ৭০ শতাংশ জমি অব্যবহৃত রয়ে গেছে। কোরিয়ান ইপিজেডের পাশেই চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। ২০১৬ সালে আনোয়ারায় ৭৫৩ একর জমিতে এটি উদ্বোধন করা হলেও ভূমি উন্নয়নের কাজ এখনো শেষ হয়নি। বেপজার তথ্য অনুসারে, এ জোনটি চালু হলে ৩৭১ কারখানা স্থাপন করা হবে এবং ১৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ৬০ কিলোমিটার গতিতে টানেল পার হতে সময় লাগে ৩ মিনিট। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে সড়ক যোগাযোগের প্রথম টানেল এটি। যা ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে সংযুক্ত করবে। এরই মধ্যে টানেলে চলাচলে সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা পর্যন্ত টোল নির্ধারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। পায়ে হেঁটে অথবা দুই ও তিন চাকার যানবাহনে যাওয়া যাবে না টানেলের ভেতরে।

প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মিত হলে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত আনোয়ারা-কর্ণফুলী শহরের বর্ধিতাংশে পরিণত হবে। এতদিন যে এলাকাটি ছিল গ্রামীণ জনপদ, সেটি হয়ে উঠবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব। মূল শহরের উপকূলে গড়ে উঠবে আরেকটি উপশহর। প্রকল্প প্রস্তাবের এই পূর্বাভাস, এখন বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে।

চালুর আগেই টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে গড়ে উঠছে ভারী শিল্প-কারখানা। গড়ে তোলা হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টানেলের কাজ শুরু হওয়ার পরপরই ওই এলাকায় বাড়তে শুরু করে জমির দাম। ৪ থেকে ৫ বছর আগে যেখানে এক গণ্ডা (২ শতক) জমির দাম ছিল ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। সেখানে জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এখন টানেলের সংযোগ সড়কের দুই পাশের জমি বিক্রি হচ্ছে প্রতি গণ্ডা ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকায়। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সেখানে জমি কিনছেন কারখানা স্থাপনের আশায়। টানেলকে ঘিরে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে তা নয়, টানেল চালু হলে গতি সঞ্চার হবে দেশে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম থেকে পণ্য পরিবহনে কমবে সময়। এতে খরচ সাশ্রয় হবে। শুধু তাই নয়, সিইউএফএলসহ কর্ণফুলী নদীর ওপারে আনোয়ারা অংশে যেসব শিল্প-কারখানা রয়েছে। সেগুলো থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হবে নতুন সুযোগ। ভোগান্তি ছাড়াই টানেল দিয়ে বন্দরে নিয়ে আসা যাবে পণ্য। আগে সিইউএফএল থেকে সার পরিবহনের সময় কারখানা থেকে সার লোড করার পর ট্রাকগুলোকে কর্ণফুলী সেতু হয়ে চট্টগ্রাম শহরের ওপর দিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে পাঠানো হতো। কিন্তু টানেল চালু হলে এখন আর ট্রাকগুলোকে শহরের যানজটে পড়তে হবে না। টানেল দিয়ে কর্ণফুলী নদীর এই পারে এসে আউটার রিং রোড হয়ে চলে যেতে পারবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। এতে নগরীতে কমবে যানজট। পণ্য পরিবহনে কমবে খরচ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত