বাজারে বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম। গত দুই মাসের ব্যবধানে শুধু নিত্যপণ্য নয়, বেড়েছে বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপি গ্যাসের দামও। এতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস-নির্ভর নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুই মাসের ব্যবধানে ৮ থেকে ৮৭ শতাংশ বেড়েছে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি, যা বেশ চাপ সৃষ্টি করছে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার তদারকি জোরদার করার পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি এবং খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র তথ্য মতে, বিদায়ি বছরের আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫২ শতাংশ, যা চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৮.৫৭ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে পণ্যের দাম বাড়ার গতি কমেছে ০.৯৫ শতাংশ। তবে বাজার পরিস্থিতি এবং গত জানুয়ারি মাসে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি কমবে না বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তবে কেউ কেউ মনে করছেন তা আরো বাড়তে পারে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বাংলাদেশের মানুষ এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছে না। বাজারে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষেরাই শুধু নন, মধ্যবিত্তরাও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে শোনা যায়। নানাভাবে ব্যয় কাটছাঁট করেও সাধারণ মানুষ পেরে উঠছেন না। সরকারি হিসাবই বলছে, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো চড়া। মানুষ কষ্টে আছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বাজারের লাগাম টানতে তাই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে জনগণ সুফল পাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযাযী, দেশে গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির লাগাম কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। তিন মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপর রয়েছে। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই দেখা যায়, গত এক বছরে বাজারে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বেশ বেড়েছে। দুয়েকটার দাম একই রকম আছে।
আর হাতেগোনা কয়েকটি পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। টিসিবির প্রতিবেদন পর্যালোচনার পাশাপাশি গত মঙ্গলবার রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার ও রামপুরা বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকটি পণ্য সরকারি তথ্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে (৩১ অক্টোবর ’২২ থেকে ৩১ অক্টোবর ’২৩) নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের। এটির দাম ১৩২ শতাংশ বেড়েছে। এখন প্রতি কেজি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১১৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও মুদ্রার বিনিময় হার এবং সুদহার বাজারভিত্তিক করার মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে বাজারে বড় কোনো প্রভাব পড়েনি। চাল ও ডালের দাম বাড়তির দিকে। পেঁয়াজ ও আলুর দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু যেভাবে বেড়েছিল, সেভাবে কমছে না। টিসিবির হিসাবে মূল্যবৃদ্ধিতে পেঁয়াজের পরই রয়েছে আলু। বাজারে এখন প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। গত এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। রুই মাছের দাম ৩৩ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ও গরুর মাংসের দাম যথাক্রমে ১১ ও ১২ শতাংশ বেড়েছে। মোটা চালের দাম গত এক বছরে ৪ শতাংশের মতো কমেছে। বাজারে এখন আবার মোটা চালের দাম কিছুটা বাড়তি দেখা যাচ্ছে। মোটা দানার ডালের দামের ক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। গত এক বছরে বাজারে মোটা দানার ডালের দাম ৬ শতাংশের মতো বেড়েছে। সরকারি হিসাবে সবচেয়ে বেশি কমেছে খোলা আটার দাম। গত এক বছরে খোলার আটার কেজিপ্রতি দাম ২৩ শতাংশের মতো কমেছে। সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৬ শতাংশ। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও মুদ্রার বিনিময় হার এবং সুদহার বাজারভিত্তিক করার মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে বাজারে বড় কোনো প্রভাব পড়েনি। গোলাম রহমান আরো বলেন, মানুষ কষ্টে আছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বাজারের লাগাম টানতে তাই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে জনগণ সুফল পাবে। অন্যথায় এভাবেই চলতে থাকবে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটের কারণে দেশে পণ্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে। লবণ, ডাল, আলুসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্য সিন্ডিকেটের কবলে। বাদ যায়নি দেশের উৎপাদিত সবজি, মাছও। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অনেক পণ্যের দাম এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
নিত্যপণ্যের এমন দামে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন একযুগে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে নিম্ন আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্ত খাবারের তালিকা ছোট করে এনেছে। শুরুতে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের করপোরেট সিন্ডিকেট থাকলেও এখন আলু ও পেঁয়াজের মতো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অনেক পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণেও সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সরকারের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। সরকারি সিদ্ধান্তকে অনেকটা দাপট দেখিয়েই উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করছে সিন্ডিকেট। পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সরকারের মন্ত্রীরাও এখন হতাশ।