সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলায় ভরপুর বাংলাদেশ আজ শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। অভাব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবনধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি জনজীবনে এক ধরনের বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে সব ধরনের সেবার মূল্য। সংসার চালাতে রীতিমতো গলদ্ঘর্ম অবস্থা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। পরিস্থিতি এমন- একজন ব্যক্তি মাসে ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেও চার থেকে পাঁচজনের সংসারের ব্যয় বহন করতে পারছেন না। যারা কিছুটা সঞ্চয় করেছিলেন, তারাও জমানো টাকা ভাঙছেন। আর নিম্ন থেকে আয়ের মানুষের অবস্থা আরো খারাপ। জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার অনেকে পরিবার থেকে পরিজন গ্রামে পাঠিয়ে নিজে শহরে থাকছেন। সবমিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আয় থেকে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে সঞ্চয় ভাঙার পাশাপাশি ধারদেনা করাটা এখন একরকম স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া খেটে খাওয়া মানুষের অর্থাৎ যারা দিন এনে দিন খান, তাদের কষ্টের সীমা নেই। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বড় স্থান করে নিয়েছে অসহনীয় পণ্যের বাজার। এ নিয়ে সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা থেকে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি অনুভব করা যায়। নিত্যপণ্যের দামের বর্তমান লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়লেও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। গরিব আছে সংকটে, আর মধ্যবিত্তরা দিশাহারা। বিশ্ববাজারে সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম তো কমেইনি, উল্টে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অগাস্ট মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৫৪ শতাংশে। এটি দেশে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির এই বিষয়টি শুধু আগস্ট মাসের বিষয় নয়, বরং গত বছরের মার্চ থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা আর ঠেকানো যায়নি এবং সেটাই এখন এত বড় আকার ধারণ করেছে। তারা বলেছেন, সরকারের ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপ এবং সেই সাথে বাজারের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যায়নি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো ২০২২ সালে দেশে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো এ বছরের অগাস্টে সেই একই পণ্য কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১১২ টাকা ৫৪ পয়সা। অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও’র তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে সারা বিশ্বে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে সর্বনিম্ন হয়েছে। এই সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। এর আগে দেশে পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টিকে ব্যবহার করা হলেও এখন সেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলেও তার প্রতিফলন কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে এই বিপুল খাদ্য মূল্যস্ফীতির পেছনে নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। ক্রেতাদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে দোকানিরা চাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্য অতিরিক্ত দামে বিক্রি করলেও নেই নজরদারি। প্রশাসনের নজরদারির অভাবে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে নিত্যপণ্য কিনতে এসে নাভিশ্বাস উঠছে তাদের। বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে সয়াবিন তেল পাম অয়েল ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা, সুপার তেল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা, ১ নম্বর সয়াবিন তেল ১৭০ টাকা ও বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬৬ থেকে ১৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি কেজি দেশি মসুরের ডাল ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা, ইন্ডিয়ান মসুরের ডাল ১০৫ থেকে ১০০ টাকা, ফাঁটি মসুরের ডাল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া মুগ ডাল প্রতি কেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকা, খেসারি ডাল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, অ্যাংকর ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ও বুটের ডাল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে প্রতি কেজি চিনি ১৩০ টাকা ও প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনি ১৩৫ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। এদিকে বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনি কিনতে ক্রেতার ৪০ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। প্রতি ডজন (১২ পিস) ডিম কিনতে বেশি খরচ হচ্ছে ২৪ টাকা। কেজিপ্রতি দেশি মুরগি ১০০ এবং ব্রয়লার মুরগি ১০ টাকা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৪৫, রসুন ১৮০, হলুদ ১৬০, আদা ২৮০ এবং মাছ ও গরুর মাংস ১০০ টাকা বেশি দাম দিয়ে ক্রেতার কিনতে হচ্ছে। এছাড়া সব ধরনের সেবার দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে। মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের ব্যবধানে বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ৫ শতাংশ করে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দুই দফায় বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় শতভাগ। বেড়েছে জ্বালানি তেলের দামও। এতে শিল্পপণ্যসহ সব ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে। চলমান এই পরিস্থিতিতে স্বল্প থেকে আয়ের মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কমাতে হচ্ছে ভ্রমণ, শিক্ষা, বিনোদনসহ অন্যান্য খাতের খরচ। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার খাবারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে বলা হয়েছে, একটি পরিবারে শুধু খাবারের পেছনে মাসে ব্যয় হচ্ছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। আর ২০১০ সালে মাসে খরচ হতো ১১ হাজার ২০০ টাকা। বেতন পান ৭১ হাজার ৫০০ টাকা। ২ বছর আগে এ টাকায় বেশ ভালোই চলতেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না। পাশাপাশি তেল ১ হাজার, মুদিপণ্য কিনতে খরচ ৩ হাজার ৩০০, সাবান থেকে শ্যাম্পু ও ডিটারজেন্ট খরচ ১ হাজার, পরিবারের যাতায়াত ব্যয় ৭ হাজার, মোবাইল ও ইন্টারনেট বিল ১ হাজার ৫০০ এবং মাসে গড়ে চিকিৎসা ব্যয় ৩ হাজার টাকা করে মোট ৭২ হাজার টাকা খরচ হয়।