পণ্য কেনাকাটা, বিল পরিশোধ, অফিসের বেতন দেওয়ার পাশাপাশি ঈদ সালামি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে অর্থ পাঠানোর মতো সেবা যুক্ত করা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ। ব্যক্তিগত লেনদেনেও আজকাল মোবাইলনির্ভরতা বাড়ছে। এছাড়া নগদ টাকার ঝক্কি এড়াতেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ফলে গত সেপ্টেম্বরে এক ব্যক্তির হিসাব থেকে অন্য ব্যক্তির হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৩০ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে লেনদেন হয়েছিল ২৫ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ৫ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে দেশের ২৫.৩৫ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আর্থিক লেনদেন করছে। অর্থাৎ তারা ব্যাংক, বীমা, ক্ষুদ্রঋণ, ডাকঘরের পাশাপাশি, নগদ বা রকেট ছাড়াও অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করছে। এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিধি বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর ভলিয়ম-১-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বুধবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিবিএস মূলত সারা দেশে চার লাখের বেশি খানা জরিপ করে এসব তথ্য দিয়েছে। এখানে তারাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যারা জরিপ চলাকালে পূর্ববর্তী ১২ মাসে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত সরকারের জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশলপত্রে বলা হয়, সম্পূর্ণভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলতে একজন উপার্জনক্ষম মানুষের সঞ্চয়, ঋণ পরিশোধ, লেনদেন, বীমাসহ সব ধরনের আর্থিক সেবায় সহজে ও নিরাপদে প্রবেশাধিকারের সুযোগ তৈরিকে বোঝানো হয়েছে। সে সুযোগ একজন নেবেন কি না, সেটি তাঁর স্বাধীন সিদ্ধান্ত। কিন্তু তিনি চাইলে যেন প্রয়োজনীয় সেবাটি নিতে পারেন, সেই সুযোগ তার জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে। ওই কৌশলপত্রে সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে শতভাগ জনগণকে আর্থিক সেবার মধ্যে নিয়ে আসার অঙ্গীকার করেছে। বিবিএস বলছে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এগিয়ে আছে শহরের মানুষ। শহর এলাকার ৩১.২৬ শতাংশ এবং গ্রামের ২২.৫১ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। লিঙ্গভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩১.০৭ শতাংশ পুরুষ এবং ১৯.৯২ শতাংশ নারী অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করে। বিভাগগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে ঢাকার মানুষ। এই বিভাগের ২৮.১৭ শতাংশ মানুষ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করে। সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে- ১৭.২৩ শতাংশ। বিবিএস বলছে, ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সিদের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট আছে এবং শুমারির পূর্ববর্তী ১২ মাসে ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অন্তত একবার আর্থিক লেনদেন করেছেন, এমন ব্যক্তিদের তথ্য দেওয়া হয়েছে শুমারিতে। জাতীয় পর্যায়ে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীর হার ৩৯.১১ শতাংশ। গ্রামে ৩৬.৬৭ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৪৪.১৯ শতাংশ। লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের ৫২.৩৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২৬.৫৭ শতাংশ নারী মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছেন। বিভাগগুলোর মধ্যে এই হার রংপুরে সর্বোচ্চ। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাড়তি কোনো টাকা ছাড়াই ঘরে বসে খোলা যায় হিসাব। শহর কিংবা গ্রামে নিমেষেই পাঠানো যায় অর্থ। কেনাকাটা, বিল পরিশোধ, ঋণ গ্রহণসহ যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নানা পরিষেবা। বিদেশ থেকে আসছে রেমিট্যান্স।
হাতের মুঠোয় মিলছে সেবা। ফলে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) ওপর মানুষের আগ্রহের পাশাপাশি বাড়ছে নির্ভরশীলতা। গ্রাহকের সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের সঙ্গে দিন দিন বাড়ছে গ্রাহকসংখ্যা। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের, ইউক্যাশ, মাইক্যাশ, শিউর ক্যাশসহ নানা নামে ১৩টির মতো ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান এমএফএস সেবা দিচ্ছে। ২০২৩ সালের জুন মাস শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি ৭২ লাখ ৬৯ হাজার। গ্রাহক বেশি হওয়ার কারণ অনেক গ্রাহক একাধিক সিম ব্যবহার করছে। লেনদেনের সুবিধার্থে একাধিক সিমে হিসাব খুলছে। নিবন্ধিত এসব হিসাবের মধ্যে পুরুষ গ্রাহক ১১ কোটি ৯৮ লাখ ৭৪ হাজার ২৯৬ এবং নারী আট কোটি ৬৮ লাখ ৪১ হাজার ৭৬৬ জন। আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৭২২, যা মে মাসে ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার ৩৪০। ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেসের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ।