কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে খাদ্যনিরাপত্তায় স্বস্তি
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে; বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মাছ, ফল, সবজি ও বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটলেও কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। পাঁচ দশকে দেশে কৃষিজ উৎপাদন সাড়ে চার গুণ বেড়েছে। ১৯৭১ সালে প্রতি হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন হতো এক মেট্রিক টন। সেখানে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ৫ দশমিক ৫৪ মেট্রিক টন। একই সঙ্গে অন্যান্য খাতেও উন্নতি হচ্ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উন্নতির প্রথম ধাপই কৃষিকে কেন্দ্র করে হয় বলে মন্তব্য করেছেন পলিসি এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ। সম্প্রতি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট : কারেন্ট ল্যান্ডস্কেপ অ্যান্ড মিশন ২০৪১’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে তিনি এসব কথা বলেন। ফিকির ৬০তম বর্ষপূর্তি ও ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো ২০২৩ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিন সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। মাশরুর রিয়াজ বলেন, ২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ভিয়েতনামের চেয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বেশি ছিল। আর থাইল্যান্ডের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। ১৯৭১ সালে দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১৩৭ মার্কিন ডলার। সেখানে বর্তমানে তা ২ হাজার ৬৮৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তোফাজ্জাল হোসেন মিয়া বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের বর্তমান আমদানি ব্যয় ১০ গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের সব দেশেরই অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুকতার দিকে গেছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। কেননা আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে থাকি। দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্যে পণ্য কিনতে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। তার কিছু সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বর্তমানে অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি চলছে তা অচিরেই সমাধান হয়ে যাবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। আর একান্ত প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আমদানি করা অন্যান্য পণ্যের দিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে ইউজি আন্ডো বলেন, জাপান বাংলাদেশের মতো এলএনজি আমদানি করে। আমাদের দেশেও সবকিছুর দাম বাড়ছে। তবে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বেতন বেড়েছে। তাতে করে অর্থনৈতিক চাপ কিছুটা কম অনুভব করছে মানুষ। সম্মেলনে জানানো হয়, ফিকি বাংলাদেশের ২১টি খাতজুড়ে ৩৫টি দেশের ২০০টিরও অধিক সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক বৈদেশিক উন্নয়ন সূচকের ৯০ শতাংশ, সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজস্বের ৩০ শতাংশ এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বাজার মূলধনের ২৫ ভাগ অবদান রাখছে বলে দাবি করে সংস্থাটি। এদিকে বাংলাদেশে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ ধানসহ দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তবে দাম বেশি থাকায় মানুষের কেনার সামর্থ্য কমে যাচ্ছে। গ্লোবাল ইনফরমেশন অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম অন ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটি ১০ নভেম্বর প্রকাশ করা হয়েছে। এফএও মনে করছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ৭ লাখ ৯৩ হাজার টন বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন হতে পারে। এর মধ্যে বোরো ধান উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হতে পারে, ৩ কোটি ১০ লাখ টন। ফলে এবার সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্য কম আমদানি করতে হবে। তবে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যপণ্য কেনার সক্ষমতা কমছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে এফএও প্রতি দুই-এক বছরে প্রতিটি দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন নিয়ে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এফএও’র প্রতিবেদনে সর্বশেষ সমন্বিত খাদ্য নিরাপত্তাসংক্রান্ত গবেষণার (ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি) তথ্য উল্লেখ করে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়েও তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যপণ্য কেনার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে করা জরিপে দেখা গেছে, দেশের ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। এর আগের তিন মাস মার্চ থেকে এপ্রিলে এমন মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৯ লাখ। অর্থাৎ, এ দুই জরিপের মধ্যবর্তী সময়ে খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৩০ লাখ। খাদ্য উৎপাদন বাড়ার পরও কেন খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তার কিছু কারণ এফওএ’র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণে উৎপাদন খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র ও বিপদাপন্ন পরিবারগুলোর খাবার কেনার সক্ষমতা কমে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির ফলে দেশের ভেতরেও খাদ্যের উৎপাদন ও পরিবহণ খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এফওএ’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডলারের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
এতে করে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ডলারসংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের জেরে প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।