ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হরতাল-অবরোধ

বিপর্যস্ত নিম্ন আয়ের মানুষ

* বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে * অর্থনীতির সব খাতে প্রতিদিন অন্তত ১৬০০-২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে
বিপর্যস্ত নিম্ন আয়ের মানুষ

বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিগত বেশ কয়েক মাস ধরেই উত্তপ্ত। কিন্তু বিশেষ করে গত এক মাসে কয়েকদফা হরতাল আর অবরোধের প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়েছে মারাত্মকভাবে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, গত এক মাসে তাদের ক্ষতি ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে এবং কেউ কেউ বলছেন রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে ব্যবসায়ীরা এখন আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিগত বেশ কয়েক মাস ধরেই উত্তপ্ত। কিন্তু বিশেষ করে গত এক মাসে কয়েক দফা হরতাল আর অবরোধের প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়েছে মারাত্মকভাবে। গত সপ্তাহ থেকে দফায় দফায় অবরোধ-হরতালে শিল্পকারখানার উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাই আর্থিক ক্ষতি কমাতে এবং ঝুঁকি এড়াতে পণ্য পরিবহণে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য ডেলিভারির তথ্যেও এমন চিত্র দেখা গেছে। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সময়মতো ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, ব্যাংক ঋণের বোঝা এড়াতে তারা বন্ধু-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করছেন। এসএমই খাতকে দেশের ‘লাইফ লাইন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই খাতটি দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অর্থনৈতিক শুমারি-২০১৩ অনুসারে, দেশে ৭৮ লাখ ৮ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোর মধ্যে ৮৭ দশমিক ৫২ শতাংশ কুটির, ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র, ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছোট, শূন্য দশমিক ০৯ শতাংশ মাঝারি ও শূন্য দশমিক ০৭ শতাংশ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উদ্যোক্তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে যখন উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তখন দেশে ছোট আকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের যেমন নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এর মধ্যেই এমন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে বেচাকেনা, আয় নেই ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের। তারা জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ এরই মধ্যে ফল, পোশাক, খেলনা জাতীয় জিনিসপত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তারও পর বিএনপি ও জামায়াতের চলমান অবরোধ ও হরতালে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। এর আগে ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হরতাল পালন করেছিল দলটি। পরে ঢাকার বাইরে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে দু-একবার হরতাল ডাকলেও ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৪৫ মাস পর আবার হরতাল করেছে। বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সারা দেশ থেকে পণ্য ঢাকায় ঢুকতে ভাড়া বেড়েছে। এতে পণ্য পরিবহণে খরচ বেড়ে গেছে। বেড়েছে দামও। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ওপরে। অবরোধের আগে এক ট্রাক সবজি বা অন্য খাদ্য পণ্য বাইরে থেকে ঢাকায় আনতে যেখানে খরচ হতো দূরত্ব ভেদে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এখন একই পণ্য একই স্থান থেকে ঢাকায় পরিবহণে খরচ গুনতে হচ্ছে ১৯ থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত। তারপরও সব ট্রাক ঢাকায় আসতে চায় না; অবরোধকারীদের অগ্নিসংযোগের আতঙ্কে থাকেন। যারা আসছেন তাদের বাড়তি টাকা দেওয়া লাগছে। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় খেতেই পচে যাচ্ছে কৃষকের পণ্য। পরিসংখ্যান বলেছে, অর্থনীতির সব খাতে প্রতিদিন অন্তত ১৬০০-২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতেই রাজনীতির মাঠে সংঘাত-সহিংসতাণ্ডনাশকতার চিরচেনা চিত্র যেন ফিরে এসেছে। বিশেষ করে ২৯ অক্টোবরের হরতাল এবং এর একদিন পর থেকে অবরোধে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এই সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। নষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি। সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় আরো বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। এমন পরিস্থিতিতে আগে থেকেই সংকটে থাকা অর্থনীতি আরো সংকটে পড়ছে। অর্থনৈতিক মন্দায় বিনিয়োগসহ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক-বীমা-পুঁজিবাজারে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আর্থিক খাতগুলো ছাড়িয়ে শিক্ষাসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, রাজনীতির আগুনে মানুষের সঙ্গে পুড়ছে অর্থনীতিও। অবরোধ ও হরতালে পরিবহন, কৃষি, পোশাক ও উৎপাদন শিল্পসহ অন্য খাতগুলোর ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে। মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদনসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। একই সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা পুঁজিহারা হচ্ছেন। রাজনৈতিক এই অস্থিরতা বাড়লে বা দীর্ঘায়িত হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে সংকট আরও গভীর হবে। ফলে হরতাল-অবরোধের নামে এমন অর্থনৈতিক বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা না হলে এই মন্দা আরও বাড়ার পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা। বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রকোপ কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন অর্থনীতিকে চাঙা করার চেষ্টা করছিল তখনই শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যার কঠিন প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। এরই মধ্যে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ যুদ্ধও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত