ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনৈতিক অস্থিরতা

চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি

চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি

একপ্রকার দুঃসময়ই পার করছে গত তিন বছর ধরে দেশের অর্থনীতি। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে অর্থনীতিকে। এই বৈশ্বিক ঘটনাগুলোর কারণে পণ্যমূল্য নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩৫ শতাংশ। অর্থনীতি যখন এসব ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টা করছে, তার মধ্যেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বিভিন্ন খাতকে নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এতে বড় হচ্ছে দেশের অর্থনীতির ক্ষত। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার প্রভাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলোতে (আইসিডি) ক্রমশ বাড়ছে খালি কনটেইনারের সংখ্যা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে সৃষ্ট ডলার সংকটের পর থেকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আগেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। এখন চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে শিল্প নেতারা আশঙ্কা করছেন। গত ২৯ অক্টোবর থেকে বিরোধী দলগুলোর ডাকা চলমান হরতাল-অবরোধে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর শিল্পগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেমন, ইস্পাত শিল্পে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, সম্প্রতি কমে গেছে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি, অনেক শিপব্রেকিং ইয়ার্ডও বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বড় ধাক্কা খেয়েছে সিমেন্ট খাতও- এ শিল্পে নির্মাণ সামগ্রীর উৎপাদন এবং বিক্রি কমেছে অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ যার ফলে খাতটির চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে। গত ২ নভেম্বর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, অক্টোবর মাসে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের বছরের একই মাসে মোট ৪.৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সে তুলনায় এটি বড় পতনেরই ঘটনা। তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সব খাতেই রপ্তানি পারফরম্যান্সের মন্দ দশা দেখা গেছে। এসব খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে চাহিদা কমে যাওয়া এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে দায়ী বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা। এছাড়া গত ২৩ অক্টোবর থেকে আশুলিয়া ও গাজীপুরের মতো তৈরি পোশাক উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রগুলোতে যে শ্রমিক আন্দোলন চলছে, তা-ও রপ্তানি চালানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন পরিবহণ বন্ধ রাখছেন মালিকরা। এতে পণ্য পরিবহণ কমে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি ও শিল্প কারখানায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামের ১৯টি আইসিডি থেকে প্রতি মাসে ৭০ হাজার বিশ ফুট সমতুল্য (টিইইউ) রপ্তানি পণ্যবাহী কার্গো কনটেইনার জাহাজীকরণ হতো। কিন্তু গত অক্টোবরে সেটি নেমে এসেছে ৪৯ হাজার টিইইউতে। নভেম্বর শেষে এই পরিমাণ ৪৭ হাজার থেকে ৪৮ হাজার টিইইউ পর্যন্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে বিকডা। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার হ্যান্ডলিং হতো ২৫ হাজার টিইইউ। এখন সেটি নেমে এসেছে প্রায় ১৭ হাজার টিইইউতে। সেই হিসাবে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমেছে ৮ হাজার টিইইউ বা ৩২ শতাংশ। ডিপো মালিকরা বলছেন, শুধু আমদানি রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং খাতে আইসিডিগুলোর প্রতি মাসে আয় কমে গেছে ১৮ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া আইসিডি পরিচালনায় সার্বিক আয় কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। কিছু কিছু আইসিডি লোকসানেও আছে। আইসিডি মালিকদের তথ্যমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে কিংবা স্বাভাবিক সময়ে আইসিডিগুলোতে প্রতিদিন গড়ে খালি কনটেইনার স্টোরেজ থাকত ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টিইইউ। ক্রমশ বেড়ে এই সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ হাজার টিইইউ। অর্থাৎ চলমান বৈশ্বিক বাণিজ্য মন্দার কারণে খালি কনটেইনার স্টোরেজে পরিমাণ বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি- অর্থাৎ শিপিং কনটেইনারের চাহিদা কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে টার্মিনালগুলোর আয়ের ওপরও। বিকডার তথ্য অনুসারে, বেসরকারি আইসিডিগুলোতে স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে আয় হতো প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। এখন সেটি নেমে এসেছে ৯০ থেকে ৯১ কোটি টাকায়। বর্তমানে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনায় লোকসানে রয়েছেন ডিপো মালিকরা। চট্টগ্রামে মোট ২১টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। এরমধ্যে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং, খালি কনটেইনার স্টোরেজসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ১৯টি আইসিডিতে। বাকি দুটি আইসিডিতে শুধু খালি কনটেইনার স্টোরেজ করা হয়। এর মধ্যে দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি আইসিডিতে আমদানি ও রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ডলার সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে নির্মাণ কার্যক্রমের গতি ধীর হয়ে পড়ায় স্টিল রোলিং মিল শিল্পের প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপ জাহাজের আমদানিও কমে গেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। শ্রমঘন এই খাতের শ্রমিকরাও পড়েছেন বিপাকে, অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। শিপব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা জানিয়েছেন, বাজারে ইস্পাতের চাহিদা ও দাম দুটিই কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে ইস্পাতের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দামেও। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্যমতে, ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র দুটি স্ক্র্যাপ জাহাজ (পরিমাণ ৮ হাজার টন) আমদানি হয়েছে। এর আগে অক্টোবরে মাত্র ৬টি (৪৮ হাজার টন) এবং সেপ্টেম্বরে ৮টি (২১ হাজার টন) স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। অথচ আগস্টে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির পরিমাণ ছিল ২৬টি (১ লাখ ৮১ হাজার টন)। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৯টি (৬৫ হাজার টন) স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। ইস্পাত খাতের ওপর চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এদিকে নির্বাচনের আগে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে ধীরগতির এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কারণে সিমেন্ট শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই নির্মাণ সামগ্রীর উৎপাদন এবং বিক্রি কমেছে অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ। স্বাভাবিক সময়ে ঢাকার বাংলামোটর সিরামিক সিটির টাইলসের দোকানে দিনে সাধারণত গড়ে ২০-২২ লাখ টাকার বিক্রি হয়। কিন্তু ২৯ অক্টোবর বিএনপির অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে কোম্পানিটির বিক্রি কমেছে ১২-১৩ লাখ টাকার মতো। পণ্য সরবরাহ এখন ৩০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। বিশেষ করে ঢাকায় এর প্রভাব বেশি পড়েছে। ইপিবির তথ্যমতে, অক্টোবরে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাক খাতের রপ্তানি ছিল ৩.১৬ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ কম। চলতি বছরের অক্টোবরে নিট পোশাকের রপ্তানি ৭.৮ শতাংশ কমে ১.৯১ কোটি ডলারে নেমেছে। অন্যান্য খাতের মধ্যে কৃষিপণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ১.৩ ও ১৬.১ শতাংশ কমেছে। এছাড়া চামড়াজাত পণ্য এবং হোম টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ৪২.২ ও ৩৮.৯ শতাংশ। অন্যদিকে, শুধু তুলা ও তুলাজাত পণ্য এবং প্রকৌশলপণ্য রপ্তানিতে যথাক্রমে ৩৬.৪ ও ১৫.৫ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত