বিশ্বে এখন প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ ক্ষুধায় কাতর। এটি যেমন একটি বাস্তবতা, তেমনি আরেকটি বাস্তবতা বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। যার থেকে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিরই কারণ না, দেহে রোগের বাসা বাঁধারও অন্যতম কারণ।
এ কারণে নিরাপদ খাদ্যের সংজ্ঞায় স্বাস্থ্যবিজ্ঞান পচাবাসী, পরিত্যক্ত কিংবা উচ্ছিষ্ট খাদ্যের কোনোটিকেই নিরাপদ স্বীকৃতি দেয় না। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে এখন প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ খাদ্যের অভাবে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। বাংলাদেশেও অনিরাপদ খাদ্যের ঝুঁকি প্রবল। তবে কখনো কখনো নিরাপদ খাদ্যের চেয়ে খাদ্য প্রাপ্তিই বড় হয়ে দেখা দেয়। করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দামামায় বাংলাদেশে তেল, চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, মাংস, দুধ, ডিমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে সরবরাহ ঘাটতি এবং দামের উত্তাপে সেটি আঁচ করা যায়।
২০০৭-২০০৮ সালের বৈশ্বিক খাদ্য সংকট এবং খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, খাদ্য ঘাটতি পূরণে আমদানিনির্ভরতা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যশস্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বণ্টন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকারের এসব পদক্ষেপের ফলে সাম্প্র্রতিক করোনা মহামারির অভিঘাত ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটেও বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার রেকর্ড পরিমাণ মজুত বাড়িয়েছে। সরকারি প্রত্যেকটি গুদামই প্রায় পূর্ণ। গত বছরের তুলনায় এখন ৩ লাখ টনেরও বেশি মজুত রয়েছে, যা খাদ্য মজুতে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। এর আগে দেশে বিগত ২০১৮ সালের অক্টোবরে রেকর্ড পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩৮ মেট্রিক টন খাদ্য। আর বর্তমানে খাদ্য মজুতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৫ হাজার ৪২৭ মেট্রিক টন। তার মধ্যে গুদামে ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০১ মেট্রিক টন চাল আর পরিমাণ ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২২৬ মেট্রিক টন গম মজুত রয়েছে। খাদ্য মজুতের এই পরিমাণ বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। চলমান অর্থ ও ডলার সংকটের মাঝে আমদানি সক্ষমতা কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এজন্য বোরো মৌসুমে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি গমের উৎপাদন- একই সঙ্গে পেঁয়াজ, আলু, ডাল ও ভুট্টার উৎপাদন বাড়াতেও আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এতে যেন কৃষকের উৎপাদন ব্যয় না বাড়ে, সেজন্য সব ধরনের সারের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, আসন্ন বোরো মৌসুমে ধান চাষের জমির লক্ষ্যমাত্রা ১.৮৮ লাখ হেক্টর বাড়ানোর পাশাপাশি চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৫ লাখ টন বাড়িয়ে ২.২৩ কোটি টন ধরা হয়েছে। একইভাবে, গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫৮ হাজার টন বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১২.২৮ লাখ টন। জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম ধীরগতিতে চললেও কৃষি মন্ত্রণালয় আসন্ন বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে নীতি বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছর উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সরাসরি প্রণোদনা হিসেবে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। এ বছর এ খাতে বরাদ্দ ৬০০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। কোনো ফসল ও শস্যের উৎপাদন বাড়াতে চাইলে সরকার এই টাকায় কৃষকদের বিনামূল্যে উন্নতজাতের বীজ ও সার সরবরাহ করবে। কৃষকরা প্রচলিত বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ধান চাষে উৎসাহী থাকে।
কিন্তু এসব জাতের ধান একই জমিতে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে চাষাবাদ হওয়ায় ফলন বাড়ছে না। তাই উৎপাদন বাড়াতে বিআর-৯৭, বিআর-৯৮, বিআর-৯৯ ও বিআর-১০০ বা বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে। এসব জাতের ফলন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ধান ও গমের পাশাপাশি ভুট্টার উৎপাদনও বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত বছরের চেয়ে ৩ লাখ টন বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে প্রায় ৬৭ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন করতে চায় মন্ত্রণালয়। রবি মৌসুমে আলুর উৎপাদন ৮ লাখ টন বাড়িয়ে ১.১৬ কোটি টন এবং অতিরিক্ত প্রায় ৩ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। গত বছর দেশে ৩৪.৫৬ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছিল। একইভাবে রসুন, মরিচ, ধনিয়া, আদা, হলুদ, কালোজিরার মতো মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রাও স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক্টর ও হারভেস্টর মেশিন সরবরাহ করাসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। দেশের ৪৯৫ উপজেলায় ২.২৭ কোটি কৃষককে ‘কৃষক স্মার্ট কার্ড’ দেওয়ার জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষি সেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা আরো জানান, বেশিরভাগ সময় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হয় না। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়ায় গত বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি হয়েছে। এবারও তেমনটিই আশা করছেন তারা।