১৪ বছর আগে ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার কম। এ সময়ে কৃষিঋণ বিতরণ ছাড়িয়ে গেছে তিনগুণ। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লিঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কমপক্ষে ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করবে না, তাদের জরিমানার ব্যবস্থা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে প্রতি বছরই সাধারণ ঋণ বিতরণের পাশাপাশি বাড়ছে কৃষিঋণ বিতরণ। এজন্য বছরের শুরুতে লক্ষ্যও ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে বছরের ১২ মাস বিশেষ করে ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা সময়মতো ঋণ পান। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিতরণকৃত কৃষি ও পল্লি ঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৩ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো ৮৪৪ কোটি এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৭ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে লক্ষ্যমাত্রার সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে বিদেশি ব্যাংকগুলো।
এই ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার ৮০ দশমিক ৬৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৩৩ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে লক্ষ্যমাত্রার ৩১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলেছেন, কৃষিঋণ বিতরণে পরিমাণের পাশাপাশি মানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে সব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করে সে জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পল্লি অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই, সেসব ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার বা এনজিও মাধ্যমে বিতরণ করে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এমআরএ) নিবন্ধিত ক্ষদ্র ঋণ সংস্থার মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুদ নির্ধারণেও এমআরএ নির্ধারিত সুদহারের যাতে বেশি সুদ না নিতে পারে সেজন্য নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। কৃষিঋণ বিতরণের পাশাপাশি কৃষকের ফেরত দেওয়ার হারও বেড়েছে। আবার কৃষিঋণে খেলাপি কৃষকের হারও তুলনামূলক কম। তথ্য বলছে, কৃষিঋণে খেলাপির হারও ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। অক্টোবর শেষে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মাত্র ৩ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা বলছেন, কৃষকরা কখনো ঋণ জালিয়াতি করেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়েন তারা। কিন্তু দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মতো ঋণখেলাপির প্রবণতা তাদের মধ্যে একেবারেই নেই। তবুও কৃষকদের স্বল্প অর্থের ঋণ আদায়ে বেশি তৎপর ব্যাংকগুলো।
মাত্র ৫ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকার ঋণ আদায়ে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মামলা করেছে ৭৪ হাজারের বেশি। তথ্য বলেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১০ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। আর অক্টোবর শেষে এ খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই চার মাসে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। এ সময় মোট ২ হাজার ১৯১ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। ৯৮০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। আলোচ্য সময়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৬৪২ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৪৮৮ কোটি এবং আইএফআইসি ব্যাংক ৪৭৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পল্লী ও কৃষিঋণ বিতরণ করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৫৪১ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ ঋণ মৎস্য খাতে দিতে হবে। প্রথম চার মাসে এ খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ১৫ শতাংশ ঋণ দেওয়ার কথা প্রাণিসম্পদ খাতে।
আলোচ্য সময়ে পশুসম্পদ ও পোলট্রি খাতে বিতরণ করা হয়েছে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এছাড়া চার মাস শেষে দারিদ্র্য বিমোচনে ৮২০ কোটি, শস্য খাতে ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭০ কোটি, সেচ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭৫ কোটি, শস্য গুদামজাত ও বিপণন খাতে ৪১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। দেশের কৃষকদের দেওয়া ঋণ সুবিধার বড় অংশই বিতরণ হচ্ছে এনজিও’র মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে কৃষকরা ঋণ পান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে। কিন্তু এনজিওর মাধ্যমে নেওয়া ঋণের সুদহার দাঁড়াচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে। প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছার সক্ষমতাই দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতের ঋণের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ এনজিওকে দিয়ে দিচ্ছে।
এনজিওগুলো ব্যাংক থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে দ্বিগুণ-তিনগুণ সুদে বিতরণ করছে। নতুন অর্থবছরে ২০২৩-২৪ কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করে নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরো কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এজন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ। এছাড়া কৃষিঋণের কত অংশ কোন খাতে দিতে হবে, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।