প্রবাসী বাড়লেও বাড়ছে না রেমিট্যান্স

* নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ২১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা * নভেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২১ শতাংশ

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ ৪ হাজার কর্মী বিদেশে গেছে। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। এ বছর শ্রম অভিবাসনের একটি ইতিবাচক দিক হলো মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত বাজারগুলোর পরিবর্তে ইতালি এবং যুক্তরাজ্যের মতো অপ্রচলিত গন্তব্যে রেকর্ডসংখ্যক কর্মী পাঠাল। তবে গেল নভেম্বর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৯৩০.০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। প্রবাসীরা ২০২২ সালের নভেম্বরে দেশে ১ হাজার ৫৯৫.১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, নভেম্বর মাসের প্রথমে ডলার রেট বেশি থাকায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছিল। কিন্তু নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে সংকটের মধ্যেও ডলারের দাম কমিয়ে আনে। এতে মাস শেষে এসে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীরা নিরুৎসাহিত হয়েছেন। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। ডলার-সংকটে রেমিট্যান্স বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বৈধপথে রেমিট্যান্স সংগ্রহে গত মাসে ভাটা পড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে ৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স কম এসেছে। যদিও করোনার পর থেকে প্রতি মাসেই বিদেশে জনসংখ্যা পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। বেড়েই চলেছে প্রবাসীর সংখ্যা। সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। যার নেপথ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স পাঠাতে জটিলতা এবং হুন্ডিতে বাড়তি দাম পাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৯৩ কোটি ডলার (১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ (প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা ধরে) ২১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। তার আগের মাস অক্টোবরে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে ১৯৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে রেমিট্যান্স কম এসেছে প্রায় ৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৮ লাখের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গেছেন। ২০২২ সালে বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। এর আগে ২০২১ সালেও ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ বাংলাদেশি শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। সব মিলিয়ে করোনার পরে বিদেশের শ্রমবাজারে নতুন করে ২৫ লাখ বাংলাদেশি যুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৪ কোটি ৪২ লাখ ৬০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে এক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৭২ কোটি ৬৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫৯ লাখ ২০ হাজার ডলার। তবে ৭ ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি। সর্বশেষ সংযোজনের ফলে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের (অর্থবছর-২৪) প্রথম পাঁচ মাসে রেমিটেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ০.২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে দেশে মোট ৮ হাজার ৮১৪.৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। গত বছর এটি ছিল ৮ হাজার ৭৯৩.৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকার অনাবাসী বাংলাদেশিদের (এনআরবি) দেশে অর্থ প্রেরণে উৎসাহিত করতে আইনসিদ্ধ চ্যানেলকে দ্রুত ও সহজ করার ব্যবস্থা নেওয়ায় দেশে রেমিটেন্সের প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লকক্ষ্য করা যাচ্ছে। টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার তুলনামূলক ভালো দর পাওয়ায় রেমিট্যান্স পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অক্টোবরের পর নভেম্বর মাসেও রেমিট্যান্স বেড়েছে। যদিও নভেম্বরের শুরুর দিকের চেয়ে শেষ দিকে ধীরগতি ছিল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৮৮১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৮৭৯ কোটি ডলার। এতে করে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২ কোটি ডলার বা শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে ১৯৩ কোটি ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে। গত বছরের একই মাসের তুলনায় যা ৩৩ কোটি ডলার বা ২১ শতাংশ বেশি। অবশ্য আগের মাস অক্টোবরের তুলনায় কমেছে ৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্স কমে যায় ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। একক মাস হিসেবে গত অক্টোবরে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পরও চার মাসে কম ছিল ৩১ কোটি ডলার বা ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে গত ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় এবিবি ও বাফেদা বৈঠক করে ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেয়, নির্ধারিত দরেই ডলার কিনতে হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকে পরিদর্শন শুরু করে। এতে করে গত ১১ নভেম্বর থেকে পরের ২০ দিনে এসেছে ১১৪ কোটি ডলার, দৈনিক যা ৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। এর মানে দর নিয়ে কড়াকড়ির পর দৈনিক গড়ে ২ কোটি ডলারের বেশি কমেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশে ডলার সংকট দেখা দেয়। সেই থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার-সংকট থাকায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৫ মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এতে ৬ মাসে রিজার্ভ কমেছে ৬ বিলিয়নের বেশি। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে রিজার্ভ থেকে কমছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের শুরুর দিকে দেশে ডলারের সংকট দেখা দিলে আমদানিতে কড়াকড়ি শর্ত আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় নিত্যপণ্য বাদে বিলাসী পণ্য আমদানিতে শতভাগ মার্জিন দেওয়া হয়। এতে এলসি নিষ্পত্তি ও পরিশোধ কমে যায়।