সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি বিনোদন খাতে
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
দেশের মানুষ এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্রভাবে অনুভব করছেন। গত বছরের আগস্ট থেকে এই চাপের শুরু। এই সময়ের মধ্যে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। এক বছর ধরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। এর মানে হলো, দেশের মানুষকে এক বছর ধরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এটি সরকারি হিসাব। তবে গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চাপ আরো বেশি। আশঙ্কার বিষয় হলো, গত আগস্ট মাসের পর থেকে টানা তিন মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে ছিল। নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে, তবে তা এখনো ১০ শতাংশের ওপরেই আছে। মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে পরের মাসেই ব্যাপক হারে কমে যাবে, তা আশা করা যায় না। সাধারণত উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা, আয় বৃদ্ধি এসবের ওপর ভিত্তি করেই মূল্যস্ফীতি কমে। তাই শিগগিরই মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নেমে যাওয়ার কথা নয়। দেশে গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। এই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমেছে, যা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নভেম্বরে গ্রাম-শহরনির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে। যদিও শহরের তুলনায় গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি, ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তবে বিবিএসের হিসাবে, একজন মানুষ ভোগের পেছনে যত টাকা খরচ করে, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ খরচ হয় চাল কেনায়। আর চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের পেছনে খরচ হয় প্রায় অর্ধেক। বাকি খরচ হয় খাদ্যবহির্ভূত পণ্য, যাতায়াত, পরিষেবা, বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য পণ্যের পেছনে। নভেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির খাতওয়ারি চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১২টি খাতের মধ্যে বিনোদনসহ চারটি খাতের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে আছে। অন্য তিনটি হলো, খাদ্যে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ; আবাসন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পরিষেবায় ১০ দশমিক ১৮; বাসাবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। এসব খাতেই সাধারণ মানুষের খরচ বেড়েছে, জীবনযাপনে অনেকের কষ্টও বেড়েছে। এছাড়া পোশাকে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং পরিবহনে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপ নিতে হচ্ছে মানুষকে। ভাত-কাপড়’ ছাপিয়ে বিনোদনেই এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। চাল, ডাল, শাকসবজি, দুধ-ডিম, মাছ-মাংস, জামাকাপড়-এসব কেনার খরচ যতটা বেড়েছে, এর চেয়ে ঢের বেশি হারে বেড়েছে নাটক-সিনেমা, খেলা দেখার খরচ। নেটফ্লিক্সের মতো বিনোদন মাধ্যমেও খরচ বেড়েছে। দাম বেড়েছে বিনোদন পার্কের টিকিটেরও। সহজ করে বললে, দৈনন্দিন জীবনে বিনোদন ও সংস্কৃতির জন্য আপনাকে আগের চেয়ে আরও বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নভেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। মূল্যস্ফীতি গণনায় এখন জাতিসংঘের ‘ক্ল্যাসিফিকেশন অব ইন্ডিভিজ্যুয়াল কনজাম্পশন অ্যাকোর্ডিং পারপাস’ বা কইকপ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সেখানে খাবার, পোশাক, আবাসন, যাতায়াত, পরিষেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ ১২টি খাতের মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়। গত নভেম্বর মাসে এই ১২ খাতের মধ্যে ‘বিনোদন ও সংস্কৃতি’ খাতে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর মানে হলো, বিনোদন ও সংস্কৃতিতে অর্থাৎ নাটক, সিনেমা, খেলা, কনসার্ট দেখা, ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আপনি যদি ২০২২ সালে নভেম্বর মাসে ১০০ টাকা খরচ করতেন, এ বছরের নভেম্বর মাসে এ খাতে আপনার খরচ বেড়ে ১১৫ টাকা ৯৩ হয়েছে। পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১৫ টাকা ৯৩ পয়সা। বিবিএস সূত্র বলছে, জীবনযাত্রার খরচে বিনোদন ও সংস্কৃতি খাতের অবদান অবশ্য ১০ শতাংশের কম।
তবে বিবিএসের হিসাবে, একজন মানুষ ভোগের পেছনে যত টাকা খরচ করে, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশ খরচ হয় চাল কেনায়। আর চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের পেছনে খরচ হয় প্রায় অর্ধেক। বাকি খরচ হয় খাদ্যবহির্ভূত পণ্য, যাতায়াত, পরিষেবা, বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য পণ্যের পেছনে। বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, করোনার পর বিনোদন ও সংস্কৃতি খাতের কর্মকাণ্ড অনেক বেড়েছে। বিনোদন জগতে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আরও বিস্তৃত হয়েছে। বিনোদন পার্কগুলোও সচল হয়েছে। আবার খাবার, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, শিক্ষার খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে বিনোদন জগতে। তাই সেখানে খরচ বেড়েছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এক-দুই বছর আগে রাজধানীর আশপাশের মোটামুটি মানের বিনোদন পার্ক বা রিসোর্টগুলোতে একদিনের জন্য খাবার ও অন্যান্য বিনোদনের জন্য জনপ্রতি দেড় থেকে ২ হাজার টাকার প্যাকেজ ছিল। এখন তা বেড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা হয়েছে। ফলে ভোক্তাকে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সব ধরনের নীতি সুদহার আরেক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ধারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রেপো ও স্পেশাল রেপোর সুদহার ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ এবং ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।