যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে রপ্তানিকারকদের

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

তৈরি পোশাক শিল্পে সম্ভাব্য বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার আতঙ্কে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের থেকে আসছে নতুন নতুন শর্ত। এ শর্তে দেশের পোশাক খাতে উদ্বেগ বেড়েই চলছে। এমনটি হলে দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের জন্য নেতিবাচক ধাক্কা।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের বৈশ্বিক ক্রেতারা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের ক্রয় আদেশে যে নতুন শর্তযুক্ত করছেন-এর মধ্যে অন্যতম হলো- বাংলাদেশ কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে পণ্য না নেওয়া কিংবা অর্থ পরিশোধ না করা। যুক্তরাষ্ট্র সরকার শ্রমনীতি ঘোষণার পর এক ধরনের উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যেক্তাদের মধ্যে। তবে দেশে শ্রম খাতের সামগ্রীক উন্নতির ফলে সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ কোনো নিষেধাজ্ঞায় পড়বে না এমন আশা করছেন।

এদিকে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে পণ্য না নেওয়া কিংবা অর্থ পরিশোধ না করার শর্ত যুক্ত করে তৈরি পোশাকের ঋণপত্র দিয়েছে একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এর ফলে নতুন করে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে এই খাতের উদ্যেক্তাদের মধ্যে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। এ বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো নতুন এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) এমন একটি শর্ত যুক্ত করেছে যে, বাংলাদেশ যদি কোনো নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়, তাহলে তারা পণ্য নেবে না; বা যদি পণ্য চালানের পরে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হয়, তবে তারা ওই পণ্যের জন্য পেমেন্ট করতে সক্ষম হবে না। তবে ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, নতুন শর্ত দেওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ল।

কারণ, এতে করে অনেক ব্যাংক মূল ঋণপত্রের বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলতে না–ও পারে। তার কারণ হচ্ছে, নতুন এই শর্তের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির পর অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিতে কিছুটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়। আবার ক্রেতা পণ্য না নিলে স্টক হয়ে যেতে পারে। তাই ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য সরকারের ওপর মহলেও কথা বলবেন বিজিএমইএর এ সভাপতি। এদিকে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে বিজিএমইএর কার্যালয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, বিশ্বব্যাপী পোশাক ব্যবসা যখন ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছে, ঠিক তখনই এই সমস্যা হাজির। এটি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। তবে পোশাক রপ্তানিকারকরা যদি আগামী ৬ মাস টিকে থাকতে পারেন, তাহলে সামনের দিনে তারা আরো শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন জানান তিনি। শ্রম অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে এমন সব দেশ ও ব্যবসায়ের ওপর গত ১৬ নভেম্বর নতুন সতর্কতা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের এক-পঞ্চমাংশ রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, যার আর্থিক মূল্য ৪৭ বিলিয়ন ডলার। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রভাব রয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে একই ধরনের উদ্বেগ দেখানো হয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৫০ ভাগই হয়েছে ইইউ এবং যুক্তরাজ্যে। ১ বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ২০২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ১.৩০ শতাংশ। এ বছরের নভেম্বরে মোট রপ্তানি হয়েছে ৪.৭৮ বিলিয়ন ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ৫.০৯ বিলিয়নের চেয়ে ৬.০৫ শতাংশ কম। জানা গেছে, শ্রম অধিকার সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র নতুন শ্রমনীতি ঘোষণার পর দুশ্চিন্তায় পড়েন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। যুক্তরাষ্ট্র গত ১৬ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার সুরক্ষায় নতুন নীতি ঘোষণা করে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ নীতি প্রকাশকালে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবে, শ্রমিকদের হুমকি দেবে, ভয় দেখাবে, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির বিষয়ে গত ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করে বাণিজ্যসচিবকে একটি চিঠি পাঠানো হয়।

ওই চিঠিতে বলা হয়, শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন এ নীতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বাংলাদেশ। কারণ, শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে এই নীতি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের ওপর আরোপের সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে একই ধরনের উদ্বেগ দেখানো হয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৫০ ভাগই হয়েছে ইইউ এবং যুক্তরাজ্যে। ১ বছর আগের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ বছরের নভেম্বরে মোট রপ্তানি হয়েছে ৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ৫ দশমিক ০৯ বিলিয়নের চেয়ে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ কম।

সম্প্রতি ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের এক প্রতিনিধি সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ ব্যবসার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে; এরফলে দোকানে মালামাল কমে যেতে পারে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে চীন ও রাশিয়া বাদে ইউরোপের দেশগুলোসহ বেশিরভাগ দেশই তা অনুসরণ করতে পারে। তিনি বলেন, ‘সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশের পোশাকের ক্রেতা থাকতে পারে; তবে যাদের ক্রয়ক্ষমতা ভালো তারা অন্য দেশে বিকল্প খুঁজবে। যদি কোনো ক্রেতা অন্য কোথাও বিকল্প খুঁজে পান, তাহলে আগের দেশে ফিরতে তার কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।’ বিশ্বব্যাপী অধিকার গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ও সরকার থেকে বাংলাদেশের ওপর চাপ বেড়েছে। দেশে ‘যারা হুমকি দেয়, ভয় দেখায়; যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী এবং শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে’ তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের এ সতর্কবার্তা উদ্বেগজনক। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশি পোশাক কর্মী কল্পনা আকতারের নাম উল্লেখ করে বাংলাদেশে শ্রম অধিকার রক্ষাকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।