বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় বেড়েছে ৮০ শতাংশ
প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
অভিবাসন, ভ্রমণ, চিকিৎসাসহ নানা কারণে রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশ যাচ্ছেন। আবার এয়ারলাইনসগুলোর টিকিটের মূল্যও বেড়েছে অর্ধেকের বেশি। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশ ভ্রমণ বাবদ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি ব্যয় করেছেন বাংলাদেশিরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশ ভ্রমণ খাতে বাংলাদেশের ব্যয় ছিল ৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে তা ১৫ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। দেশের সেবা খাতে ব্যয়ের বড় দুটি খাত হলো পরিবহন ও ভ্রমণ ব্যয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে বিদেশ থেকে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন ব্যয় কিছুটা কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থল, জল, আকাশ ও রেলপথে বিদেশ থেকে পণ্য আনা-নেয়ায় বাংলাদেশের ব্যয় ছিল ৭১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ব্যয় ৭০ হাজার ৬১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসাবে পরিবহন খাতে ব্যয় কমেছে ১ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। বিপরীত ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যয়ে। গত অর্থবছরে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। আর ৮১ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়েছে ব্যক্তিগত ভ্রমণ ব্যয়। দেশের ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ। বিভাগটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, সরকারি-বেসরকারি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য বিদেশ ভ্রমণে গেলে সেটি ব্যবসায়িক ভ্রমণ হিসেবে দেখা হয়। আর পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, ধর্মীয়সহ অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বিদেশ গেলে সেটিকে দেখানো হয়েছে ব্যক্তিগত ভ্রমণ ব্যয় হিসেবে। এ ব্যয় মূলত এয়ারলাইনসের টিকিট মূল্য। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিবাসন, পর্যটনসহ নানা কারণে বিদেশগামী যাত্রীর সংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এয়ারলাইনসগুলোও টিকিটের দাম বাড়িয়েছে অস্বাভাবিক হারে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রার ব্যয় এত পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদ উল আলম বলেন, ‘গত অর্থবছরে বিদেশগামী যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে ৩২-৩৫ শতাংশ। দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো এ সময়ে টিকিটের মূল্য ৫০-৫৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। এ কারণে আগের চেয়ে বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় বেড়েছে। এক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ারও প্রভাব রয়েছে।’ এ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘?দেশে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো তাদের টিকিট বিক্রির টাকা প্রত্যাবাসন করতে পারছে না। এজন্য তারা একাধিকবার সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে। টিকিট বিক্রির টাকা প্রত্যাবাসন করতে না পারায় বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা বাংলাদেশে স্বল্পমূল্যের টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এদিক থেকেও বাংলাদেশি যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’ বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, শুধু ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৫ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশ গেছেন। ২০২২ সালে বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। যাত্রী চাপ বেড়ে যাওয়ায় গত বছর মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশিরা প্রায় দ্বিগুণ দামে এয়ারলাইনসের টিকিট কিনতে বাধ্য হয়েছেন। একই পরিস্থিতি হয়েছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকাগামী বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও। বিদেশগামী এয়ারলাইনসের টিকিটের মূল্য বাড়লেও দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ভাড়া কমেছে বলে জানান এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব মফিজুর রহমান। বেসরকারি উড়োজাহাজ পরিচালনা প্রতিষ্ঠান নভোএয়ারের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘?বিদেশগামী যাত্রীর সংখ্যার পাশাপাশি এয়ারলাইনসের টিকিটের মূল্য বেড়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রুটে টিকিটের মূল্য বাড়ানো হয়নি। যদিও এয়ারলাইনসগুলোর খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে গত ফেব্রুয়ারি থেকেই অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনাকারী সব প্রতিষ্ঠান লোকসান দিচ্ছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশ থেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণকারীর সংখ্যা ও এর ব্যয় খুবই কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যবসায়িক ভ্রমণ খাতে ব্যয় ছিল প্রায় ২৮৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ব্যয় ৪০৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশের বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় ছিল প্রায় ৮ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ ব্যয় উন্নীত হয় প্রায় ১৫ হাজার ৫২৮ কোটি টাকায়। এক্ষেত্রে দেশের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৮১ দশমিক ২২ শতাংশ। রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি হওয়ায় প্রতি বছরই দেশের বিপুল অংকের অর্থ বাণিজ্য ঘাটতি হিসেবে থাকছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।
আমদানি কমিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ঘাটতি ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব হলেও গত অর্থবছরে সার্ভিসেস অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের সেবা খাতে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ঘাটতি বেড়ে ৪১ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। সে হিসেবে ঘাটতির পরিমাণ ১০ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা বেড়েছে। গত অর্থবছরে সেবা খাতে মোট ব্যয় ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। একই সময়ে সেবা খাত থেকে ৬৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা আয়ও করেছে বাংলাদেশ।