রাজধানীর চকবাজারের একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের কাজ করেন সুরুজ মিয়া। শরীয়তপুরের এই মানুষটির ঢাকায় বসবাস প্রায় একযুগ ধরে। বেতন-ভাতা যা পেতেন তা দিয়ে অনেক কষ্টে দিন চললেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুরু হলে পড়ে যান বিপাকে। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুঁজতে থাকেন কোথায়, কবে টিসিবির ট্রাক আসবে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ট্রাকের দেখা মিললে লম্বা লাইনে দাঁড়ান। পণ্য নিয়ে তৃপ্তির হাসি দিয়ে গন্তব্যে ফেরেন। কিন্তু নিম্ন আয়ের এই মানুষটির সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাটে টিসিবির পণ্যের অপেক্ষায়। এতে ব্যাঘাত ঘটছে কাজের। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে চাকরি হারানোর। আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদ এলাকার বাসিন্দা মানসুরা বেগম বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। তারও অবস্থা মহব্বত আলীর মতো। টিসিবির পণ্য নিতে গিয়ে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের মাধ্যমে খোঁজ রাখেন কবে ট্রাক আসবে। যেদিন ট্রাকের জন্য বের হন, সেদিন যে বাসায় কাজ করেন সেখান থেকে অণুনয়-বিনয় করে ছুটি নিয়ে আসতে হয় তাকে। তারা সবাই সকাল ৯টার মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাব কিংবা খাদ্য ভবনের সামনে ট্রাকের জন্য অপেক্ষা শুরু করেন। কিন্তু দুপুরের আগে ট্রাকের দেখা মেলে না। আর মানুষের ভিড় এত বেশি থাকে যে, পণ্য হাতে পেতে কখনো সন্ধ্যাও হয়ে যায়। গত মঙ্গল ও বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টিসিবির ট্রাক সেলের সামনে তাদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। দিনভর অপেক্ষার পর যখন হাতে পণ্য পান, তখন মনে হয় একেকজন যুদ্ধ জয় করেছেন। সুরুজ মিয়া বলেন, ‘মাসে এক দুইবার যদি মাল পাই ওইগুলো বাড়ি পাঠাইয়া দেই। দোকানের চেয়ে তো ট্রাকে দাম অর্ধেক। বড় উপকার হইতেছে।’ বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের কাজ করে কীভাবে দিনভর অপেক্ষা করেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেকটা অসহায় চাহনি দিয়ে ষাটোর্ধো এই মানুষটি বলেন, ‘যেদিন গাড়ির জন্য বের হই ওইদিন পানি ছাড়তে সমস্যা হয়, ভাড়াটিয়াদের কথা শুনতে হয়। বাড়িওয়ালা কয়েকবার চাকরি দেখার জন্যও বলছে। কিন্তু না আইসা উপায় আছে? বাঁচতে তো হইবে।’ গত ১৪ নভেম্বর থেকে রাজধানীতে ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাকে সয়াবিন তেল, ডাল, আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবি। খোলা ট্রাকে আলু প্রতি কেজি ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৫০ টাকা, ডাল ৬০ টাকা ও তেল ১০০ টাকা লিটারে বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে দুই কেজি ভারতীয় পেঁয়াজের দাম ৪০০ টাকা উঠেছিল। দুই কেজি আলুর দাম ১২০ টাকা। দুই কেজি মোটা মসুর ডাল ২৩০ টাকা, দুই লিটার রাইস তেলের দাম ৪০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকারও বেশি পণ্য ট্রাকে মিলছে ৫৪০ টাকায়। ক্রেতারা বলছেন, এই চার পণ্যের বাজারদর হিসাব করলে প্রায় অর্ধেক দামে কেনা যাচ্ছে। যে কারণে নিম্ন আয়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী অনেকেই সুযোগ পেলে টিসিবির পণ্য কিনে স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করছেন। বাজারে পণ্যের দাম যত বাড়ছে, টিসিবির লাইনও তত লম্বা হচ্ছে। ক্রেতারা জানান, এক প্যাকেজে ৫৪০ টাকায় চারটি জিনিস পাচ্ছেন। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলেও সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না কেউ। মঙ্গল ও বুধবার সরেজমিন প্রেসক্লাবের সামনে দেখা গেছে, ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যরা শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সবার হাতে টোকেন দিয়ে দিয়েছেন। নারী-পুরুষরা আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য নিতে পারছেন। কিন্তু পণ্য কিনতে আসা মানুষের এত ভিড়, যা সামাল দিতে পুলিশকেও হিমশিম খেতে দেখা গেছে। রিওন নামের একজন পুলিশ সদস্য বলেন, ‘যত মানুষের জন্য পণ্য আছে তার চেয়ে মানুষ অনেক বেশি। এজন্য আমরা শৃঙ্খলা যাতে হয় সেই চেষ্টা করছি। না হলে মারামারি হওয়ার ভয় আছে। যেভাবে পারছে মালামাল নিচ্ছে।’ মাসে এক দুইবার যদি মাল পাই ওইগুলো বাড়ি পাঠাইয়া দেই। দোকানের চেয়ে তো ট্রাকে দাম অর্ধেক। বড় উপকার হইতেছে। তবে সচিবালয়ের আশপাশে থাকা ভাসমান বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ, আনন্দবাজার এলাকার বাসিন্দারা অনেকেই ট্রাক আসার খবর পেয়ে এক পরিবারের একাধিক লোক লাইনে দাঁড়ান বলে অভিযোগ অন্য এলাকা থেকে আসা মানুষের। অবশ্য এমন অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে। রুহুল আমিন নামের একজন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা ট্রাক আসলে খবর পাই। আশপাশে থাকলে তাড়াতাড়ি চইলা আসি। নইলে লাইনে অনেক পেছনে পড়তে হয়।’ ছয় বছরের ছেলে জুলহাস আলমকে সঙ্গে নিয়ে নাজিরা বাজার থেকে আসা রহিমা আক্তার বলেন, ‘ছেলের বাবা দোকানে চাকরি করেন।