জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য

বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী অভিবাসন বেড়েছে

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

চাকরিদাতা দেশগুলো খুঁজছেন দক্ষ ও যোগ্য প্রার্থী। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে পদভেদে হাজার হাজার, এমনকি লাখো আবেদন পড়ে। কিন্তু পছন্দমতো যোগ্য প্রার্থী অনেক সময়ই পান না তারা। তবে বদলেছে চিত্র। এবার বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান চলতি বছর ২২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালে বিদেশে দক্ষ কর্মী গিয়েছিল ২.৫২ লাখ, চলতি বছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩.০৮ লাখ। করোনার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন প্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা এখন ঊর্ধ্বমুখী। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে প্রায় দ্বিগুণ কর্মী বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। ১৯৭৬ সালের পর থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী অভিবাসন হয়েছিল গত বছরে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের বিদেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে। ২০২২ সালে বিদেশে দক্ষ কর্মী গিয়েছিল ২ দশমিক ৫২ লাখ, চলতি বছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৮ লাখ। সেই হিসাবে চলতি বছর দক্ষ শ্রমিকের অভিবাসন বেড়েছে ২২ শতাংশ। অন্যদিকে স্বল্প-দক্ষ (অদক্ষ হিসেবে পরিচিত) কর্মী অভিবাসনের হার গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ২৩ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ থেকে স্বল্প-দক্ষ (অদক্ষ হিসবে বেশি পরিচিত) কর্মী অভিবাসনের হার গত পঞ্জিকাবর্ষের তুলনায় এ বছর প্রায় ২৩ শতাংশ কমে ৬.২৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ (বিএমইটি) ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ রেকর্ড ১২ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে দক্ষ কর্মী অভিবাসনের হার ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ এবং অদক্ষ শ্রমিক প্রায় ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান চলতি বছর ২২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালে বিদেশে দক্ষ কর্মী গিয়েছিল ২.৫২ লাখ, চলতি বছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩.০৮ লাখ। এ বছর প্রায় ২.৬১ লাখ লক্ষ আধা-দক্ষ কর্মী বিদেশে গেছেন, যেখানে ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৪২ হাজার ৭৭১ জন। এ বছর চিকিৎসক, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি বিশেষজ্ঞসহ ৫০ হাজার ১৫৮ জন পেশাদারও কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন, আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৪০ জন। কর্মী নিয়োগকারীদের তথ্য মতে, কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে বেশি বিদেশে গেছেন ড্রাইভার, কেয়ারগিভার, গৃহকর্মী, আতিথেয়তা কর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান, কোয়ালিটি কন্ট্রোল সুপারভাইজার; রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনার, প্লাম্বিং ও পাইপ ফিটিং এবং সাধারণ বৈদ্যুতিক কর্মী। বিশেষজ্ঞরা এবং নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এই অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্ববাজারের দক্ষ কর্মীর চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে, কারণ দেশের অর্ধেক শ্রমশক্তিই অদক্ষ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে স্বল্প বেতনের শ্রমের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে ধরা হয়। এ কারণেই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কর্মীপ্রতি কম রেমিট্যান্স পায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অদক্ষ বাংলাদেশিদের অভিবাসন বেশি হওয়ার মূল কারণ তৃণমূল পর্যায়ে ঠিকমতো কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করতে না পারা, মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ শ্রমিকদের বড় চাহিদা এবং স্থানীয় শিল্পগুলোতে প্রচুর প্রশিক্ষিত কর্মীর কর্মসংস্থান। দেশে বিএমইটির অধীনে ১১০টির মধ্যে ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পুরোদমে চালু থাকলেও প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা মোট শ্রম অভিবাসীদের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি নয়। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয়ের না থাকায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা-সরবরাহে অসামঞ্জস্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি সরবরাহের জন্য বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত ও পূর্ণ সজ্জিত নয়। তবে প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারে। এর মধ্যে ৪০টি প্রকল্প চলমান আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশিরা উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ালে বিদেশিদের ওপর শিল্প মালিকদের নির্ভরতা এমন থাকবে না। চাহিদা ও যোগ্যতার এই ফারাকের কারণ ব্যাখ্যা করে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষায় সনদ পাওয়া শিক্ষার্থীরা শিল্পের উৎপাদন, বিপণন পর্যায়ে চাকরি করতে আগ্রহী নয়। তাদের আগ্রহ সরকারি চাকরি, ব্যাংক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিলের কাজ। কিন্তু চাকরির বাজারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে একটি শিল্প স্থাপিত হলে সেখানে কর্মকর্তা পর্যায়ে যদি ১০ জন লোক নিয়োগের দরকার হয়, দক্ষ, আধাদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের দরকার হয় শতাধিক। উচ্চশিক্ষায় অতি ঝোঁকের ফলে উচ্চ শিক্ষিতরা কর্মকর্তা পদে চাকরি না পেয়ে বেকার থাকছে, অন্যদিকে শিল্প-কারখানাগুলো শ্রমিক সংকটে ভুগছে। দেশের মোট আটটি খাতে চাহিদার তুলনায় বর্তমানে শ্রমিক কম রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজার। সঙ্গে রয়েছে মধ্যম সারির কর্মকর্তার সংকটও। ফলে অনেক বেশি বেতন দিয়ে বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে আনতে হয়। দেশে দক্ষ জনবলের অভাবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাংলাদেশে বিভিন্ন এনজিও, তৈরি পোশাক, বস্ত্র খাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে শ্রমিক ঘাটতি প্রকট হচ্ছে। শিল্পকারখানায় এখন অসংখ্য পদ খালি। দেশে শিক্ষিত বেকারের অভাব নেই। তবে অভাব রয়েছে দক্ষ শ্রমশক্তির। দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হচ্ছে না বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর। দক্ষ কাজের লোক পাচ্ছেন না কারখানার মালিকরা। অগণিত কর্মক্ষম মানুষ বেকার থাকার পরও শ্রমিকের অভাবের জন্য দক্ষতার অভাবকে দায়ী করছেন শিল্পমালিকরা। আগামী বছরগুলোয় শিল্পের প্রয়োজন মেটাতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা ৫৩ শতাংশ টেকিনিক্যালি মোটামুটি দক্ষ এবং ৪০.৭ শতাংশ একেবারেই অদক্ষ। দেশের শিল্প খাতে বছরে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ দক্ষ কর্মী প্রয়োজন, কিন্তু সে পরিমাণ দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না। ৩৬ শতাংশ নিয়োগদাতাই ভুগছেন দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ কর্মী সংকটে। দেশের অর্থনীতি ক্রমে কৃষিনির্ভর থেকে শিল্পনির্ভর হচ্ছে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না।

সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন (৩ কোটি) দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে চায়। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) এক সেমিনারে সোমবার এ তথ্য উঠে এসেছে। বর্তমানে বছরে দেশে ২১ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যে সামান্য অংশই দক্ষ রয়েছে। বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পতে সাড়ে ১৮ লাখ এবং বিদেশের শ্রমবাজারে ৫ লাখ দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। ‘বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই কর্মক্ষম। যদিও বেকারত্বের হার ১২.৩ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে ১৮-৩৫ বছর বয়সি জনসংখ্যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ কোটিতে। বিএমইটি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ১১.৩৭ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছিল। কিন্তু ওই বছরে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর সংক্ষিপ্ত কোর্সের অধীনে মাত্র ১.২০ লাখ লোক প্রশিক্ষণ পেয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন প্রশিক্ষণ পেয়ে ওই বছরেই বিদেশে গেছেন, তা জানে না কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ২০১৯ সালের হিসাব অনুসারে, একজন বাংলাদেশি প্রবাসীর পাঠানো গড় মাসিক রেমিট্যান্স হচ্ছে ২০৩.৩৩ ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুসারে ২২ হাজার ৩২৩ টাকা), যেখানে একজন ফিলিপিনো শ্রমিকের পাঠানো গড় মাসিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫৬৪.১ ডলার। অর্থাৎ ফিলিপাইনে প্রবাসী কর্মীরা বাংলাদেশি কর্মীর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠান।