শীতের মৌসুম শুরু হয়েছে। বাজারে উঠতে শুরু করেছে শীতকালীন শাকসবজি ও মসলাজাতীয় পণ্য। এসব পণ্যের বাজারদর শুনেই নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। অথচ এসব কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ঘরে তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে কৃষকদের। পণ্য উৎপাদনে চাষির নিজের শ্রম ও সময়ের মূল্য কখনও যুক্ত করা হয় না। তারপরও কৃষিপণ্যের দাম যতই বাড়ুক না কেন, লভ্যাংশের খুব কম অংশই কৃষকের ঘরে আসে। এক কেজি পটোল উৎপাদনে চাষির খরচ সাড়ে ৭ টাকা। স্থানীয় পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। ঢাকার কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে দাম পড়ে মানভেদে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর খুচরা বাজারে সেই পটল কিনতে একজন ভোক্তাকে গুনতে হয় ৮০ টাকা পর্যন্ত। চাষি থেকে কয়েক হাত ঘুরতেই একই সবজির দাম বেড়ে হচ্ছে ১০ গুণ। চাষি, পাইকারের সঙ্গে কথা বলে ও সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সবজির দাম বিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া যায়। হাত বদলে পাইকারি ও খুচরা বাজারের দামের এই ফারাক শুধু পটলে নয়, প্রায় সব সবজিতেই। সরকারি তথ্যই বলছে- বর্তমানে বেগুন, করলা, ঢ্যাঁড়স, লাউ, চিচিংগা, কচুরলতি, টমেটো, শসাসহ বিভিন্ন সবজি বিক্রি হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে ছয় থেকে দশগুণ বেশি দামে। এর মধ্যে শুধু পাইকারি ও খুচরা বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে দাম বাড়ছে প্রায় চারগুণ। এছাড়া রয়েছে অস্বাভাবিক পরিবহন ব্যয়, রাস্তায় চাঁদাবাজি, উৎপাদনকেন্দ্র থেকে বিক্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত দফায় দফায় আড়তদারি (কমিশন) খরচসহ নানা অসঙ্গত ব্যয়। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে বর্তমানে ঢাকার বাজারে কোনো সবজি প্রতি কেজি ৬০ টাকার নিচে মিলছে না। এতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। চাষিও পাচ্ছে না পর্যাপ্ত দাম। মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন।
সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ের জনবল ও গবেষণা শাখার মাধ্যমে দেশের ২৭টি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ণয় করেছিল। প্রতিটি পণ্যের জন্য আলাদা আলাদা ৬৯ জন চাষির কাছ থেকে তাদের পণ্যের উৎপাদন খরচের তথ্য নেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, দেশে প্রতি কেজি পটল উৎপাদনে চাষির খরচ ৭ টাকা ৫২ পয়সা। বেগুন উৎপাদন খরচ ৯ টাকা ২০ পয়সা, করলা ১১ টাকা ৪৭ পয়সা, ঢেঁড়সের ১০ টাকা ৭৯ পয়সা, চিচিংগার ৮ টাকা ৩০ পয়সা, লাউয়ের ৫ টাকা ৩৩ পয়সা, টমেটোর ৮ টাকা ২১ পয়সা এবং শসার ৮ টাকা ৪ পয়সা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়, প্রতিবেদনটি দুই বছর আগের। অর্থাৎ, এর মধ্যে সার ও সেচের খরচ কিছুটা বেড়েছে। সে হিসাব ধরলে বর্তমান খরচ কেজিপ্রতি আরো ১/২ টাকা বাড়তে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সবজির ফলনও এসময় কিছুটা বেড়েছে, সে বিষয়টি মাথায় নিলে আবার দামের খুব বেশি তারতম্যও হয়নি। ওই প্রতিবেদনে ফসলের উৎপাদন পর্যায়ে চাষির সব খরচের উল্লেখ রয়েছে। যেমন- পটোল উৎপাদনের ক্ষেত্রে একজন চাষির প্রতি একরে ব্যয় হয় ৯৫ হাজার ৫৬৪ টাকা। এর মধ্যে জমি তৈরিতে খরচ ৩ হাজার ২০৬ টাকা, সার বাবদ খরচ ১০ হাজার ৫৭৮ টাকা, বীজ বাবদ খরচ ৩ হাজার ৭৬৭ টাকা, শ্রমিকের খরচ ৩৭ হাজার ৪৪৪ টাকা, সেচ খরচ ৭ হাজার ৫৬ টাকা, বালাই ব্যবস্থাপনার খরচ (কীটনাশক ও অন্যান্য) ৮ হাজার ৮৯ টাকা।
শুধু এ খরচই নয়, এর মধ্যে জমি লিজ বা নিজস্ব হলেও সেজন্য ভাড়া/খরচ রয়েছে একরপ্রতি ১৭ হাজার টাকা। আবার চাষের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ হলে তার সুদও হিসাবে নেওয়া হয়েছে, যা ২ হাজার ১০৩ টাকা। পাশাপাশি অন্যান্য খরচ ৬ হাজার ৩২২ টাকা হিসেবে মোট খরচ ধরা হয়েছে। এদিকে এক একরে পটলের উৎপাদন ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৭১১ কেজি। এতে দাম আসে প্রতি কেজি ৭ টাকা ৫২ পয়সা।
যেখানে চাষিরা সবজি বিক্রি করেন (গ্রামগঞ্জের হাট) সেখান থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত এখন কয়েক স্তরে মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে। জানতে চাইলে মহাস্থান হাটের আড়ত মালিক জয়নাল জানান, তার কাছে পণ্য পৌঁছার আগে দু-হাত ঘুরে এসেছে। এতে দামের তারতম্য প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর মধ্যে পরিবহন ও শ্রমিক খরচ রয়েছে। একদফা আড়তদারি (কমিশন) দেওয়া হয়েছে। তারা এরপর মুনাফা নিয়ে চাহিদামতো সারাদেশের বিভিন্ন শহরের পাইকারি আড়তে পাঠান। সেখানেও একদফা আড়তদারি দিতে হয়। এরপর রাজধানীর ক্ষেত্রে সে সবজির বড় অংশ আসে কারওয়ান বাজারে। সেখানে ট্রাক থেকে পণ্য আবারও আড়তে নেন ব্যবসায়ীরা। আড়তে চাহিদামতো কয়েক হাত বদল হয়। দাম বেড়ে যায় আরেকগুণ। কারণ মুনাফা করতে সেখানে রয়েছে শত শত পাইকার, ফড়িয়া ব্যবসায়ী, মজুতদার এবং রপ্তানিকারকের প্রতিনিধি। এছাড়াও সেখানে নানা ধরনের সবজি থেকে নিজের চাহিদার পদের সবজি কিনে নেন কিছু পাইকারি বিক্রেতা। আবার কখনো সরাসরি আড়ত থেকে খুচরা বিক্রেতারা কেনেন। আর প্রতিটি কেনা-বেচায় ব্যবসায়ীদের পকেটে মুনাফার পাশাপাশি দিতে হয় আড়তদারি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কৃষিপণ্য কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে যেতে ন্যূনতম তিন দফা হাত বদল হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ী প্রত্যেক স্তরের ব্যবসায়ীরা কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি লাভ করেন। রাজধানীতে সবজি আনেন এমন কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে ঢাকায় ১৪ টন সবজি পরিবহনে আগে ভাড়া ছিল ২০ হাজার টাকা। এখন ভাড়া গুনতে হচ্ছে যথাক্রমে ৩০-৩২ হাজার টাকা। গত কয়েক মাসে প্রতিটি পথের ভাড়াই বেড়েছে গড়ে ২৫ শতাংশ। এছাড়া পরিবহন খরচ ছাড়াও আছে হাটের টোল খরচ, বস্তাজাত করার শ্রমিক ও কুলি খরচ। এছাড়া পথে পথে চাঁদা। সেখান থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে বগুড়া বাইপাস, শেরপুর, কড্ডার মোড়, এলেঙ্গা বাইপাস, টাঙ্গাইল বাইপাস, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই-তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।
একদিনে ২৫ টাকার কচুর লতি ৮০ টাকা হয় যেভাবে জয়পুরহাট থেকে কচুর লতি যায় সারাদেশে। রপ্তানিও হয় সেখানকার লতি। ঢাকার খুচরা বাজারে এসে ওই লতির দাম হয়ে গেছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। একই দিন রাতে কারওয়ান বাজারের টিনশেড মার্কেটের আড়তে ওই লতি ৪০ থেকে ৪৩ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। আর পরের দিন (২১ ডিসেম্বর) সকালে রামপুরা বাজারে সে লতি বিক্রি হচ্ছিল ৮০ টাকা। এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের গত বছর আরেকটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য। তাতে কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে যেতে কীভাবে কৃষিপণ্যের দাম বাড়ে, তা দেখানো হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফড়িয়ারা ৬ থেকে ৭, পাইকাররা ১১ থেকে ২১ শতাংশ লাভ করেন। যেখানে রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীরা মুনাফা করেন ৩৩ থেকে ৪৬ শতাংশ। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম) ৩০টি পণ্যের উৎপাদন ব্যয়, খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রির একটি তালিকা প্রতিদিন দিয়ে থাকে। ওই তালিকা অনুযায়ী এক কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যয় ৩৩ টাকা ৪ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সে অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে এর যৌক্তিক মূল্য দাঁড়ায় কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা। কিন্তু গত ১২ ডিসেম্বর পণ্যটি পাইকারি পর্যায়েই বিক্রি হয়েছে ৭৫-১৮০ টাকা কেজিতে। গত বছর একই সময়ে এর দাম ছিল ৪৫-৫৫ টাকা। সে হিসাবে পণ্যটির দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ।
ডিএএমের হিসাবে রসুন ও আদার উৎপাদন ব্যয় ৫০ দশমিক ৫২ টাকা, খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য হতে পারে ৬৫ টাকা কেজি। কিন্তু বর্তমানে রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৭০-২৪০ টাকায়; গত বছর যার মূল্য ছিল ৭০-১০০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ২০৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আদার দাম গত বছর ছিল কেজিপ্রতি ১১০-১৮০;
বর্তমানে তা ২০০-২৮০ টাকা। দাম বেড়েছে ৬৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। দেশে গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরেও তা ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশে। বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।