বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, ডিম ও মাংসে স্বনির্ভর হওয়া গেছে। কিন্তু এখনো দেশের ৭৩ শতাংশ মানুষ দৈনিক প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর খাবার পায় না। খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের বেশ বড় একটা অংশ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। কৃষিতে বিনিয়োগ না বাড়ালে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে না। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সংলাপে এসব তথ্য জানানো হয়। দেশের ৩২ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে। এসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি খাতে মাথাপিছু বিনিয়োগ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিচের সারিতে। নেদারল্যান্ডস কৃষি খাতে বছরে মাথাপিছু ৩১৪ ডলার, ভারত ৩৪ ডলার ও মিয়ানমার ২৬ ডলার বিনিয়োগ করে। সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১৬ ডলার বিনিয়োগ করা হয়। যে কারণে বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি ধানের উৎপাদন ৪ হাজার ৭৩৫ কেজি। আর চীনে তা ৭ হাজার কেজির বেশি। অন্যদিকে দেশে কৃষিজমি কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সমস্যা বাড়ছে। তাই খাদ্যনিরাপত্তাকে টেকসই করতে হলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একরপ্রতি ধানসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে দেশের কৃষি খাতে ঋণ বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এ খাতটিতে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেবে ব্যাংক, যা এর আগের বছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৪৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ বা ১৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ১২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার ৪১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা মোট কৃষিঋণের স্থিতি ৫৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা বকেয়া। সার্বিকভাবে কৃষি খাতে ঋণখেলাপির হার ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৮৭৮ কোটি। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কমপক্ষে ২ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে। যেসব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করবে না, তাদের জরিমানার ব্যবস্থা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে প্রতিবছরই সাধারণ ঋণের পাশাপাশি বাড়ছে কৃষিঋণ বিতরণ। এ জন্য বছরের শুরুতে লক্ষ্যও ঠিক করে দেওয়া হয়। যাতে বছরের ১২ মাস বিশেষ করে ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা সময়মতো ঋণ পান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে শস্য, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি উৎপাদন খাতে বেশি ঋণ নিয়েছেন কৃষকরা। আলোচিত সময়ে কৃষকের ঋণ পরিশোধও সন্তোষজনক। এ সময় আগের নেওয়া ঋণ কৃষক ফেরত দিয়েছেন ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা; যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর কৃষিঋণের লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য প্রণীত কৃষিঋণ নীতিমালায় বলা হয়, ভবনের ছাদে বিভিন্ন কৃষিকাজ করা একটি নতুন ধারণা। বর্তমানে শহরাঞ্চলে যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত বাড়ির ছাদে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ফুল, ফল ও শাকসবজির যে বাগান গড়ে তোলা হয়, তা ছাদবাগান হিসেবে পরিচিত। ব্যাংকাররা বলেছেন, কৃষিঋণ বিতরণে পরিমাণের পাশাপাশি মানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। যাতে সব ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণ করে সেজন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পল্লী অঞ্চলে নিজস্ব শাখা নেই, সেসব ব্যাংক যাতে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার বা এনজিরও মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (এমআরএ) নিবন্ধিত ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুদ নির্ধারণেও এমআরএ নির্ধারিত সুদ হারের যাতে বেশি সুদ না নেওয়া হয় সে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। দেশের কৃষকদের দেওয়া ঋণ সুবিধার বড় অংশই বিতরণ হচ্ছে এনজিওর মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে কৃষকরা ঋণ পান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে। কিন্তু এনজিওর মাধ্যমে নেওয়া ঋণের সুদহার দাঁড়াচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে। প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছার সক্ষমতাই দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতের ঋণের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ এনজিওকে দিয়ে দিচ্ছে। এনজিওগুলো ব্যাংক থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে দ্বিগুণ-তিনগুণ সুদে বিতরণ করছে। চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করে নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।