ঝুঁকি কম, লাভ বেশি। তাই অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি আখ চাষেও ঝুঁকছেন কৃষকরা। উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলা আখ চাষের জন্য উপযুক্ত। এবার আখের উৎপাদন বাড়ছে। সরেজমিন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আখের মান ভালো হলে পাইকাররা জমি থেকেই ৩০ থেকে ৪০ টাকা পিছ দরে আখ কিনে নিয়ে যান। একবার আখ চাষ করলে ২-৩ বছর ফলন পাওয়া যায়। গোড়া থেকে আখ কেটে নিলে অবশিষ্ট অংশ থেকে আবার নতুন আখ জন্মায়। এছাড়া বিক্রির সময় কেটে রাখা গাছের আগা থেকেও চারা উৎপাদন করা যায়।
প্রতি বিঘা জমিতে বছরে লাখ টাকার ওপরে লাভ পাওয়া যায়। জাকির হোসেন নামে এক চাষি বলেন, ‘আখ চাষে আমার খরচ কম হয়েছে কারণ আমি নিজেই সব কাজ করি। ২০ শতাংশ জমিতে তার মাত্র ২৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।’ ২নং ইউনিয়নের আখ চাষি আব্দুল বাতেন অভিযোগ করে জানান, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাইনা, সরকার যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করতো, তাহলে আরো ভালো করতে পারতাম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকল এলাকায় আখ চাষ বাড়ছে।
ফলে এবার পূরণ হয়েছে চলতি রোপণ মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রা। চলতি মাড়াই মৌসুমে ৪০ দিনে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। আর মিলগেটে প্রতি মণ আখের দাম ধরা হয়েছে ২২০ টাকা। গত শুক্রবার থেকে মাড়াই মৌসুম শুরু হয়। গত ২০২২-২৩ মাড়াই মৌসুম মিলটি আখের অভাবে মাত্র ২৮ দিনে শেষ করে। ওই মৌসুমে কৃষকরা মাঠে আখ রোপণ না করায় মিলের রেকর্ডে সব থেকে কম সময় উৎপাদনে ছিল। এ সময় মিলটি ৩৫ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ১ হাজার ৭৪৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করেছিল। ওই বছর আখের মণ ছিল ১৮০ টাকা, একই সময় ২০২২-২৩ রোপণ মৌসুমে কৃষকরা আখ চাষ করেছে ৩ হাজার ১০০ একর। যদিও মিলের রেকর্ড বলছে, এর আগে প্রতি মৌসুমে মিল এলাকার কৃষকরা ৮ থেকে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আখ চাষ করত। আখের মূল্য বৃদ্ধি না করায় এ সংখ্যা দিন দিন কমছিল। তবে মিলের কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও অতি প্রয়োজনীয় এ চিনিশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আখের মূল্য আরও বৃদ্ধি ও জাত উন্নয়ন, আখ চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও বিকল্প শিল্পকারখানা গড়ে তোলা এবং মোটা অঙ্কের ঋণ সুদ মওকুফ করলে মিলটি লাভজনক শিল্পে পরিণত হবে বলে জানিয়েছেন তারা। কালীগঞ্জের বলিধাপাড়া মাঠে ২ একরে আখ চাষ করেছেন কৃষক ইসরাইল হোসেন। তিনি জানান, আখের দাম বাড়ায় তারা খুশি। তার মতো অনেক চাষি ঝুঁকছেন আখ চাষে। মিলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার মণ্ডল জানান, চলতি রোপণ মৌসুমে ৫ হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত এক মাসে ২ হাজার ৫০ একর জমিতে চাষ হয়েছে। সামনে আরও এক মাসে প্রায় ১ হাজার জমিতে কৃষকরা আখ চাষ করবে বলে তাদের আশা। এ ছাড়া মাঠে দণ্ডায়মান ৩ হাজার একরের মধ্যে প্রায় ২ হাজার একর মুড়ি আখ থাকবে। সব মিলিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ মাড়াই মৌসুমে আখ রোপণ ও চিনি উৎপাদন বাড়বে। কৃষকরা আখের মূল্য বেশি পাওয়ায় এ বছর চাষে আগ্রহ দেখিয়েছেন। মোবারকগঞ্জ সুগার মিল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২২-২৩ মাড়াই মৌসুমে লাভক্ষতির কোনো হিসাব এখনও শেষ হয়নি। তবে ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে মিলটির লোকসান হয়েছিল ৬৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর আগের বছর ২০২০-২১ আখ মাড়াই মৌসুমে মিলটি চিনি উৎপাদন করে ৭ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন। এই পরিমাণ চিনি উৎপাদন করতে মিলের লোকসান দিতে হয়েছে প্রায় ৭৬ কোটি টাকা। মোবারকগঞ্জ চিনিকলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের আইন ও দরকষাকষি সম্পাদক গোলাম রসুল জানান, কৃষকের আখের মূল্য আরও বাড়াতে হবে। আখের মূল্য বৃদ্ধি করলে কৃষকরা আখ চাষ করবে। মিলের প্রধান এবং একমাত্র কাঁচামাল আখ। সেই আখ চাষ বৃদ্ধি করা না গেলে মিল বাঁচানো যাবে না। মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, আখের দাম বৃদ্ধি করে ২২০ টাকা মণ করা হয়েছে। গত বছর ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ পাওয়া গেছে। এ মৌসুমে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আখ পাওয়া যাবে। ৬ হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই ভারী শিল্পটি। প্রসঙ্গত, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকার মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপন করে। এর মধ্যে ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর জমিতে পুকুর এবং ১০৭ একর জমিতে পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার রয়েছে।