প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের অব্যাহত ঘাটতি প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশ; এই অবস্থায়, কারখানা সচল রাখতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার বাড়াচ্ছে। এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলওবি) এর তথ্যমতে, ১৮ লাখ টনে পৌঁছেছে বাংলাদেশের বার্ষিক এলপিজি ব্যবহারের পরিমাণ, এর মধ্যে ১৩ শতাংশই করছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান। মাত্র ৫ বছর আগের ২ শতাংশের তুলনায় যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই পরিবর্তনের জন্য শিল্প সংশ্লিষ্টরা এলপিজির ব্যয়-সাশ্রয়ী দিকটি ভূমিকা রাখছে বলে জানান। এতে ডিজেলের চেয়ে ৬২ শতাংশ কম খরচ হয়। অবশ্য শিল্প কারখানার বয়লার চালাতে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে লাভজনক হলো প্রাকৃতিক গ্যাস, কিন্তু এর সরবরাহ কমায় কারখানা মালিকরা বাধ্য হয়ে এলপি গ্যাসের দিকে ঝুঁকছেন। সরকারি কৌশলগত নীতি সহায়তা দিলে শিল্পকাজে এ জ্বালানি ব্যবহার এক বছরের মধ্যেই দ্বিগুণ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এলপিজি অপারেটররা। এর আগে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা (সিএনজি) খাতে সরকার এ ধরনের নীতি সমর্থন দিয়েছে, বর্তমানে থ্রি-হুইলার যানবাহনে এই জ্বালানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। তারা বলেছেন, যন্ত্রপাতি আমদানির কর কমানো হলে এলপিজিকে জ্বালানি হিসেবে গ্রহণ করাটা আরও বাড়বে, ফলে দেশব্যাপী এটি সিএনজির মতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো নীতি সহায়তা না থাকলেও বাজারের বর্তমান প্রবণতার ভিত্তিতে শিল্প বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, আগামী ৫ বছরের মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠানে এলপিজি ব্যবহার দ্বিগুণ হবে। চলতি বছরের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এলপিজি অপারেটরদের পক্ষ থেকে একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়।’ এলপিজি : বাংলাদেশের শিল্পের জন্য বিকল্প জ্বালানি সমাধান’ শীর্ষক প্রতিবেদনের উপস্থাপনায় তারা বলেছে, ডিজেল বা বিদ্যুতসহ অন্যান্য শিল্প জ্বালানির চেয়ে এলপিজি প্রায় ক্ষেত্রেই অনেক বেশি ব্যয় সাশ্রয় করে। এলওবির সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, ‘শিল্পের পরিচালন ব্যয় ব্যাপকভাবে কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে এলপিজির। তাই এটি একটি আকর্ষনীয় বিকল্প। সরকার যদি এলপিজি ব্যবহারের একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতি ঠিক করে দেয়, তাহলে শিল্প প্রতিষ্ঠান এই জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহী হবে।’ প্রতিবেদনের উপস্থাপনায় তিনি আরো বলেন, ‘বাজারের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে, এলপিজিকে বিকল্প শিল্প জ্বালানিতে পরিণত করতে সরকার একটি নীতি প্রণয়ন করতে পারে। এতে এলপিজি কোম্পানিগুলো আগামী ৫ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারবে।’ আজম জে চৌধুরী বলেন, এলপিজি সংযোগ নিতে প্রাথমিকভাবে ব্যয় হয় দেড় কোটি টাকা, সে তুলনায় প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ নিতে লাগে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা। সরকার এলপিজি আমদানিতে অনেক কর প্রণোদনা দিলেও- এলপিজি সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ কর দিতে হয়। সরকারি নীতির মাধ্যমে এসব বাধা দূর হলে, তা এলপিজি প্রসারে সহায়ক হবে। এলপিজি একটি বহুমুখী জ্বালানি হওয়ায় হিটিং, ডায়িং এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন শিল্পকাজে ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন শিল্প প্রক্রিয়ার সাথে অভিযোজনযোগ্যতা থাকায় এটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্পের জন্য একটি সুবিধাজনক জ্বালানি। অপারেটররা বলছেন, এসব সুবিধাই বাংলাদেশে শিল্প-জ্বালানি হিসেবে এলপিজির প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখছে। এলওবি’র মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ব্যবহৃত প্রাথমিক জ্বালানির মধ্যে এলপি গ্যাসের অংশ ছিল ৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যা ছিল মাত্র ১ শতাংশ। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) একটি প্রাক্কলন উদ্ধৃত করে এলওবি জানায়, প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসাবে সমস্ত নতুন এবং বিদ্যমান পারিবারিক গ্রাহক পর্যায়ে এলপিজি চালু করার সরকারি নীতির কারণে ২০৩২ সালের মধ্যে এলপিজির চাহিদা বার্ষিক ৬০ লাখ টন বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে। এলওবি’র তথ্য মতে, দেশে মোট ২৭টি এলপিজি অপারেটর রয়েছে। এদের মধ্যে ৯টি বর্তমানে দেশের মোট এলপিজি চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি পূরণ করে। বাজারের এসব শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওমেরা, বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, নাভানা, বিএম এবং ওরিয়নএলপিজি খাতে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এদিকে আমদানির ক্ষেত্রে এক সংকটের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের এলপিজি খাত। এ শিল্পের অভ্যন্তরীণদের মতে, দেশের এলপিজি কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের পক্ষেই আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। অথচ, রান্নার গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনেও এর ব্যবহার হচ্ছে। দেশে এলপিজি বাজারজাতকারী একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান- ওমেরা এলপিজি’র হেড অব ফাইন্যান্স আতিয়ার রহমান জানান, গত দুই বছরে শিল্প প্রতিষ্ঠানে এলপি গ্যাস বিক্রিতে ২০০ শতাংশের মতো ব্যাপক উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।