ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাছের আঁশ

রপ্তানি বৈচিত্র্যে আশা জাগানো নতুন পণ্য

রপ্তানি বৈচিত্র্যে আশা জাগানো নতুন পণ্য

জীবন কখন, কীভাবে, কাকে এনে কোথায় যে ফেলে দেয়- তার কিছুই ঠিক নেই। খুলনার মো. জুলফিকার আলম যেমন জীবনেও ভাবেননি মাছের আঁশের ব্যবসা করবেন। আর এখন পুরো ধ্যানজ্ঞানই তার এই ফেলনা জিনিসটি। রপ্তানি তো করছেনই, রীতিমতো দেশে আন্তর্জাতিক মানের প্রক্রিয়াকরণ কারখানা করার চিন্তা করছেন।

১৬ বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে করেন জুলফিকার। বলেন, ‘বিদেশি এক ক্রেতার সঙ্গে পরিচয় হয় খুলনায়। তিনিই বুদ্ধি দিলেন প্রথম। মাছের আঁশ প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। কীভাবে সম্ভব, তা শিখিয়েও দিলেন তিনি। সেই যে হাঁটা শুরু করলাম, আর পেছনে তাকাইনি।’ শুরুর দিকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি মাছের আঁশগুলো যাতে ফেলে না দেওয়া হয়। বাজারে বাজারে নিজে ঘুরে বেড়াতেন। বলতেন যত্ন করে এগুলো জমিয়ে রাখতে। বিনিময়ে থোক হিসেবে মাসিক একটা টাকা দিতেন। এখন অবশ্য কেজি দরে কিনতে হয়। প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা। জুলফিকার আলম জানালেন, দেশজুড়ে এখন একটি বলয় গড়ে উঠেছে তার। বিশেষ করে বন্দর এবং জেলা পর্যায়ে। অন্তত ২০০ লোক সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত। বাজারে যারা মাছ কাটেন এবং আঁশ ছাড়ান, প্রথম কাজটা তাঁরাই করেন। কীভাবে- জানতে চাইলে বলেন, ‘আমিই শিখিয়ে দিয়েছি। পানি ও কেমিক্যাল দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে। একসময় মাছ কাটার পর মাছের আঁশ ছাড়িয়ে ফেলে দেওয়া হতো। মাছ থেকে ছাড়ানো এসব আঁশ কোনো কাজে লাগত না। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব আঁশ থেকে লিপিস্টিক এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাছের আঁশ। মাছের আঁশ সাধারণত উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য হিসেবে বিবেচনা করে ফেলে দেওয়া হয়। সেই আঁশ এখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে শুরু করেছে, যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ রপ্তানি করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেড় দশক আগে মাছের আঁশ রপ্তানি শুরু হয়। এখন শুধু চীনেই প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার টন আঁশ রপ্তানি করা হচ্ছে। চীন আবার মাছের আঁশ জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে রপ্তানি করে। মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন ও জেলাটিন পাওয়া যায়, যা ওষুধ, প্রসাধনসামগ্রী ও সম্পূরক খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। দেশে কয়েক হাজার মানুষ আঁশ সংগ্রহের কাজে যুক্ত। ফলে দেশের প্রায় প্রতিটি বাজারে মাছ কাটার পর আঁশ সংগ্রহ করার প্রবণতাও বেড়েছে। মাছে-ভাতে বাঙালি বাংলাদেশের মানুষের কাছে মাছ বরাবরই জনপ্রিয় থাকলেও মাছের আঁশের কোনো কদর ছিল না অতীতে। কিন্তু সেই ফেলে দেওয়া পণ্যটিই এখন রপ্তানি আয় আনছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ সাত-আটটি দেশে রপ্তানি হয়। এই রপ্তানিকারকদের একজন জুলফিকার আলম। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিটি বাজারে যারা মাছ কাটেন, তারা সবাই আঁশ ফেলে না দিয়ে সংগ্রহ করে রেখে দেন। সারা দেশ থেকেই আমরা আঁশ সংগ্রহ করি। এক সময় যে পণ্যটি ফেলে দেওয়া হতো, সেটি থেকে আমরা এখন রপ্তানি আয় করছি। তাদের কাছ থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসব আঁশ সংগ্রহ করে ময়লা দূর করে ধুয়ে শুকিয়ে নেন। এরপর রপ্তানিকারকরা সেগুলো প্রক্রিয়া করে বিদেশে রপ্তানি করেন। যদিও মাত্র ১০ থেকে ১২ জন ব্যক্তি আঁশ রপ্তানি করেন, কিন্তু সব মিলিয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ৫ হাজারের বেশি মানুষ। এখন বাংলাদেশ থেকেই প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার টন আঁশ রপ্তানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে। সেখানে মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন ও জিলেটিন তৈরি করা হয়। ওষুধ, প্রসাধন সামগ্রী, ফুড সাপ্লিমেন্ট তৈরিতে মাছের আঁশ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া কোলাজেন ও জিলেটিন মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি হয়, যা ওষুধ ও প্রসাধন সামগ্রীতে কাজে লাগে। মাছের আঁশ দিয়ে আসলে কী হয়? বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মাছের আঁশে আছে কোলাজেন ফাইবার আ্যামাইনো এসিডের মতো কয়েকটি গুণ। ফলে এই আঁশ দিয়ে তৈরি হয় পাউডার, যা ওষুধ শিল্প, প্রসাধনী শিল্প ও খাদ্য শিল্পসহ পরিবেশ রক্ষার নানা সামগ্রীতে কাজে লাগে। মাছের আঁশ সংগ্রহের ফলে পরিবেশও দূষণমুক্ত হচ্ছে বলে পরিবেশবিদদের অভিমত।

যশোরের মাছবাজার ঘুরে দেখা গেছে, যশোরে মাছের আঁশের চাহিদা এখন অনেক বেশি। মাছ কাটার কাজ করেন এমন আরো একজন জাহিদ। তিনি জানান, শুধু আঁশ নয় মাছের নাড়িভুঁড়িও বিক্রি হয়। নাড়িভুঁড়ি ব্যবহার করা হয় মাছের খাদ্য হিসেবে। শুনেছি এগুলো শুকিয়ে বিদেশেও পাঠানো হয়। মাছের ফুলকো শুকনো করে বিদেশে সুপ তৈরি হয়। এছাড়া মাছের ফুলকা, পিত্ত, চর্বি দিয়ে আরো অনেক রকমের জিনিস তৈরি হয়। শহরের শুধু বড় বাজার নয়, আশপাশের সব বাজারের বটি ওয়ালারাও নাড়িভুড়ি ও আঁশ বিক্রি করে থাকেন। কেউ কেউ বাসাবাড়ি থেকেও মাছের আঁশ সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন মাছের আঁশে আছে কোলাজেন ফাইবার আ্যামাইনো এসিডের মতো কয়েকটি গুণ। ফলে এই আঁশ দিয়ে তৈরি হয় পাউডার, যা ওষুধ শিল্প, প্রসাধনী শিল্প ও খাদ্য শিল্পসহ পরিবেশ রক্ষার নানা সামগ্রীতে কাজে লাগে। মাছের আঁশ সংগ্রহের ফলে পরিবেশও দূষণমুক্ত হচ্ছে বলে পরিবেশবিদদের অভিমত। রপ্তানি প্রাক্রিয়াজাতকরণ সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মাত্র ১০ থেকে ১২ জন ব্যক্তি আঁশ রপ্তানি করেন। তবে এই ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ৫ হাজারের বেশি মানুষ। প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ সাত থেকে আটটি দেশে রপ্তানি হয়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছে, প্রতিদিন ২৫ টন মাছের আঁশ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বর্তমানে রপ্তানিকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন বিভিন্ন বাজার থেকে ১০ টন করে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে থাকে। এতে প্রতি মাসে ৩০০ টন মাছের আঁশ রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। তবে স্থানীয় বাজারে পাওয়া মাছের আঁশ সম্পূর্ণ রপ্তানি উপযোগী করা গেলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রতি মাসে ৭৫০ টন। স্থানীয়ভাবে এর মূল্যসংযোজনের হার ৯৩.৫০ শতাংশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত