সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে বাজার
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
সিন্ডিকেট একটি মারাত্মক বস্তু। এই জিনিস নিরাকার; কিন্তু বেজায় শক্ত। সবাই মুখে বলে ‘ভাঙব’, কিন্তু আদতে কেউ তা ভাঙে না। ভাঙতে পারে না। কারণ, সিন্ডিকেট হলো রুল না মানা ভিমরুলের চাক টাইপের একটি সমবায়ি কনসেপ্ট। এই জিনিসে কেউ খোঁচা মারতে চান না। বিদ্যমান শীতের মধ্যেও চরম গরম নিত্যপণ্যের বাজার। নতুন আলু-পেঁয়াজ আসার পর ভোক্তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হলেও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখনো লাগামহীন। নানা পদক্ষেপেও কেন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না বাজার- এমন প্রশ্ন বাড়তি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হওয়া ক্রেতাদের। খুচরা ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, ক্রেতারা যত সচেতন হবেন, তত সহজ হবে তাদের এ জিম্মি দশার সমাধান। বাজারে নিত্যপণ্যের দামে দিশাহারা এক ক্রেতা বলেন, আমি আমার পুরো জীবনে ৮০ টাকা দরে আলু কিনিনি। যাদের টাকা আছে, তাদের তো কোনো মাথাব্যথা নেই। চাহিদা না কমলেও মানুষ এখন বাধ্য হয়ে কম কিনছেন। কারণ, বাজারে পণ্যের দাম অনেক বেশি। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব, এক বছরে কেজিতে আলুর দাম বেড়েছে ২২৮.৯৫ শতাংশ। এ সময়ে ১২৯.৪১ শতাংশ বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের দাম এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৭৭.৭৮ শতাংশ।
এদিকে, বছর ব্যবধানে দেশি রসুনের দাম বেড়েছে ১৮২.৩৫ শতাংশ এবং চিনির দাম বেড়েছে ২৬.৬৭ শতাংশ। তাছাড়া অধিকাংশ পণ্যের দামই বেড়েছে বছরজুড়ে। স্থবির আয়ের বিপরীতে এভাবে নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির জোয়ার থেকে মুক্তি চান ক্রেতারা। এক ক্রেতা বলেন, মোটামুটি একটি চাকরি করেও আমরা বাজারে এসে হিমশিম খাচ্ছি। বিক্রেতারা পেঁয়াজ মজুত করে রেখে বলেন, সরবরাহ নেই। তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে অনেক কিছুই করা হয়েছে; কিন্তু হয়নি শুধু ভোক্তাদের ভোগান্তির সমাধান। অতি মুনাফা লোভীদের থামাতে আইন প্রয়োগে আরো কঠোর না হলে সিন্ডিকেটের শেকল ভাঙা সম্ভব নয়। আমরা সবাই মোটামুটি জানি, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এক জোট হয়ে আইন ভেঙে মাল মজুত করে; কখন কতটুকু পণ্য বাজারে ছাড়তে হবে, আড়তে কত টাকা দাম ধরতে হবে, খুচরায় কত বিক্রি হবে, সব তারাই ঠিক করে। এটি ঘোর অন্যায়। যেভাবে পুলিশ ও প্রশাসন আর পাঁচটা অপরাধ মোকাবিলা করে, এই ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটার কথা ছিল না। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটছে। আমাদের খাদ্যপণ্য নিয়ে ব্যবসা করা যে ‘কয়েকটা হাউস’ আইন ভাঙে ও ‘আর্টিফিশিয়ালি দাম বাড়ায়’, তাদের যেখানে শ্রীঘরে থাকার কথা; সেখানে তাদের ভিআইপি মর্যাদা দিয়ে বৈঠকের কক্ষে ডাকার কী কারণ এবং তাতে কাজের কাজ কতটুকু হয় বা হয়েছে, সে এক বিরাট প্রশ্ন। সরকার নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে দেশের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের বিধান আছে। আজ পর্যন্ত মজুতদারির জন্য কোনো ব্যবসায়ীকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে বলে কেউ কখনো শুনেছে বলে মনে পড়ছে না। বরং সিন্ডিকেটের শয়তানি বন্ধ না করে বিকল্প হিসেবে আমরা সেই পণ্য ‘আমদানি করি বা বিকল্প ব্যবস্থা এমনভাবে করি যাতে তারা বাধ্য হয় দাম কমাতে।’
বাজারে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে, তখন মন্ত্রীদের কাছ থেকে আমরা দিকনির্দেশনামূলক কোনো বক্তব্য পাচ্ছি না। তারা একেকজন একেক রকম বক্তব্য দেন, যাতে সাধারণ মানুষ আরও বিভ্রান্তিতে পড়েন। দেশে ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে সংকটে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য এতটাই বেড়েছে যে, কিছু মানুষ চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যপণ্য কিনতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছে। অন্যদিকে ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠছে একশ্রেণির মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা হিসাব। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাবে টাকার পরিমাণ আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে। একই সময়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বা কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের ব্যাংক হিসাবে কমে এসেছে টাকার অঙ্ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে বর্তমানে সব পণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাবে টাকাও বেড়েছে। মজুদদারি বন্ধ করে অসৎ ব্যবসায়ীদের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের টাকা জমা থাকে মূলত পাঁচ ধরনের হিসাবে। এক. কৃষকদের ব্যক্তিগত হিসাব, দুই. কৃষি ও কৃষিভিত্তিক পণ্য প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাব, তিন. আমদানি-রপ্তানিকারদের হিসাব, চার. ব্যক্তিগত হিসাব এবং পাঁচ. ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের ব্যক্তিগত হিসাব। এই পাঁচ শ্রেণির সবাই ভোগ্যপণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে জড়িত। প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কৃষক ও কৃষিপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আমানত কমলেও বাকি তিন ধরনের হিসাবে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যক্তিগত (হাউসহোল্ড) হিসাবে আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৯৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৫৯৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ছিল এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যক্তি হিসাবে ২৯ হাজার ১৯৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার বড় একটি অংশ ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের টাকা। আলোচ্য তিন মাসে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের হিসাবে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ হাজার ৪৫২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিল্পপতিদের (ব্যক্তি) হিসাবে ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৭৮৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে জুন প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এছাড়া আমদানি-রপ্তানিকারকদের ব্যাংক হিসাবের টাকার অঙ্ক ২০ হাজার ৫৯২ কোটি থেকে ২০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আমদানি-রপ্তানিকারকদের হিসাবে ১২ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে থাকা টাকার পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ১১০ কোটি। জুন মাসে কৃষকদের হিসাবে ৩২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা থাকলেও সেপ্টেম্বরে আমানত ৩১ হাজার ৪২৫ কোটিতে নেমে এসেছে। কৃষি ও কৃষিভিত্তিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই অবস্থা। জুন শেষে তাদের ব্যাংক হিসাবে ছিল ১৩ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু তিন মাসের ব্যবধানে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা কমে ১২ হাজার ১৯৭ কোটিতে নেমে এসেছে কৃষিভিত্তিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত। কিন্তু বাজারের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, আলু থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এই সুযোগে পকেট ভারি হচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর। গত ২৩ ডিসেম্বর দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে সমন্বয়হীনতা ও মূল্যবৃদ্ধির চিত্র ফুটে উঠেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) প্রতিবেদনে। তাদের হিসাবে চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা ও রসুনের দাম গত ৫ বছরের ব্যবধানে ১২ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।