২০২৩ সালজুড়ে অর্থনীতির সব খাত নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা ছিল। নানা ঘটনা অর্থনীতিকে বছরজুড়ে চাপে ফেলেছে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে জনজীবনে।
ব্যাংক খাত : বছরজুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল দেশের ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণ, মূলধন সংকট ও ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে সারা বছর শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল।
আমানত বাড়লেও তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে জমা করেনি। বেনামি ঋণ ও ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বছরের শেষ সময়ে এসে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডলার সংকট : ২০২২ সালের মার্চে শুরু হওয়া ডলার সংকট ২০২৩ সালের পুরোপুরি দেখা গেছে। তবে ২০২৩ সালে আগের মতো ডলারের দাম ধরে না রেখে ধীরে ধীরে তা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে।
এতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা হলেও ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কিনছে ১২২-১২৩ টাকা দামে। ফলে এর চেয়ে বেশি দামে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। বছরজুড়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ ধরে রাখা নিয়ে চাপে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ আইএমএফের ঋণের শর্ত ছিল, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অন্তত ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের নেট রিজার্ভ থাকতে হবে।
তবে তাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ সারা বছরই প্রতি মাসে গড়ে অন্তত এক বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। তাতে নেট রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি আছে, তবে মোট রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন।
মন্দা পুঁজিবাজার : এদিকে দেশের পুঁজিবাজার পরিস্থিতি মন্দা অবস্থানে রয়েছে। পতন ঠেকাতে কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যের ওপর ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে রেখেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। সর্বনিম্ন দামে আটকে আছে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারমূল্য। এদিকে মন্দার বাজারে কারসাজি থেমে নেই। সবচেয়ে আলোচিত কারসাজি হয়েছে আইএফআইসি ব্যাংকের নামে আমার বন্ড বিক্রিতে।
২০২৩ সালে অর্থনীতি যে চাপের মধ্যে ছিল তার প্রতিফলন ঘটেছে সংশোধিত বাজেটে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল তা থেকে সরে এসেছে।
বাজেট ঘোষণার সময় প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন হয় সাড়ে ৭ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। অবশ্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ বছর যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না সেটি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি এরই মধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরাও একই মত দেন। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এডিবি বলেছে, এটি হতে পারে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থনীতির নিম্নমুখী সূচক : বছরের প্রথম মাসগুলোতে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ভালো থাকলেও শেষ দিকে এসে পরিস্থিতি খারাপ হয়। সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানিতে কিছুটা গতি বাড়লেও অক্টোবর, নভেম্বরে ধারাবাহিকভাবে কমে যায়। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়া ও মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। দেশের রপ্তানি খাতের জন্য ভীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের গুজব। বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠান, খাত ও ব্যক্তির ওপর স্যাংশন আরোপ করতে পারে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো।
রেমিট্যান্স প্রবাহে ওঠানামা : ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ ওঠানামা করে। হুন্ডির দাপটে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়ে। এ ছাড়া প্রবাসী আয় কমার অন্যতম কারণ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে ডলারের দামে পার্থক্য। অবশ্য মোট পাঁচ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন লক্ষ করা যায়। রপ্তানি আয় কমে যাওয়া প্রবাসী আয়ে ধীরগতি ও ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের চাপে থাকে। আমদানি ব্যাপক কমে যায়। শিল্পের মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের আমদানি কম হওয়ায় বিনিয়োগে খরা চলে।
বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ : অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ২০২৩ সালে দেশের অর্থনীতি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা ভালো ছিল না। ডলার সংকট সারা দুনিয়াজুড়ে ছিল। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ কম এসেছে। বিদেশি ঋণও কম এসেছে।
এসব কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে ২০২৩ সালের অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অস্থিরতা থাকায় ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ডলারমূল্য একবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
এটাকে আস্তে আস্তে বাজারভিত্তিক করতে হবে। রপ্তানিতে কিছুটা শ্লথ গতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে সামনে আরও বাড়বে।