নতুন বছরের উপহার
ইতিবাচক অর্থনৈতিক সূচক
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
দেশে ডলার সংকট এখনো কাটেনি। চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ঘোষণা দিয়ে আমদানি বাণিজ্যের লাগাম টানা হয়েছে। অর্থাৎ, সামষ্টিক অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়েছে। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট। এতে উৎপাদনও কম হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এলো নতুন একটি বছর। অনেকের মনেই প্রশ্ন- নতুন বছরের অর্থনীতি কেমন হবে? কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সমালোচনা হচ্ছে। টাকা পাচার ও ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিয়ে নানা ধরনের কথাও উঠছে। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়েও চলছে আলোচনা। অবশ্য বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা আশাবাদী, ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙা থাকবে এবং বেশ স্বস্তি বিরাজ করবে। তাদের ধারণা, ২০২৩ সালের অর্থনীতি থাকবে যথেষ্ট গতিশীল। বিশ্বায়নের এই যুগে বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিভিন্ন ঘটনা দেশীয় অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পরবর্তী সময়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে অস্থিরতা; সব মিলিয়ে অমীমাংসিত কয়েক ডজন সমস্যা নিয়ে শুরু হচ্ছে ২০২৪ সাল। চলতি বছর অক্টোবরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক জিডিপির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক জিডিপি আরও কমে ২ দশমিক ৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে।
এর আগে ২০০০-২০১৯ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক গড় জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। সে সময়ের জিডিপির তুলনায় বর্তমান ও আগামী বছরের পূর্বনির্ধারিত জিডিপিকে প্রত্যাশিত মার্জিন লাইনের নিচের জিডিপি বলে আখ্যায়িত করেছে আইএমএফ। আইএমএফের ইকোনমিক আউটলুকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ, যা চলতি বছর এসে কমে দাঁড়িয়েছে ৬ শতাংশে। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপি বাড়া কিংবা কমার সম্ভাবনা নেই। আগামী বছরও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ থাকবে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি। তবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ও আগামী বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। চলতি বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ছিল বেহালদশা। পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল বিয়োগের খাতায়। তবে আইএমএফ ধারণা করছে, আগামী বছর পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, আগামী বছর সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকবে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো। যেখানে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ, সেখানে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর জিডিপি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা আগামী বছরের জন্য বিশ্বে সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রার জিডিপি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ডলার সংকট প্রশমন, মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া, ব্যাংকিং খাত ঠিক রাখা, রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিছু কিছু চ্যালেঞ্জে সমাধান না এলেও প্রশমনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। ভূরাজনীতির উত্তেজনা আগে থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে জেঁকে বসে আছে। সর্বশেষ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাগরের গুরুত্বপূর্ণ এক জলপথে জাহাজের ওপর ইয়েমেনের হুতি যোদ্ধাদের হামলা। এ হামলা আবার ঘটছে গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের জেরে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির জগতে টালমাটাল যে অবস্থা ইতিমধ্যে রয়েছে, তাতে অস্থিতিশীলতার আরেকটি ডোজ যুক্ত হয়েছে। একটি ঝামেলাপূর্ণ বছরের শেষে বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের নতুন সূর্যকে স্বাগত জানাতে হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে। এই চ্যালেঞ্জকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন বলে অভিহিত করছেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যদি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। ২০৪১ সালের স্বপ্ন, উন্নত সমৃদ্ধিশালী দেশের পথে অগ্রসর হবে বাংলাদেশ। বিদায়ি বছর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে পার করল বাংলাদেশের অর্থনীতি। ব্যাংকিং খাতে নগদ আদায় কমে যাওয়ায় পাহাড় ছুঁয়েছে খেলাপি ঋণ। কমে গেছে আমানত প্রবাহ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এতে বেড়ে গেছে সরকারের ব্যাংক ঋণ। ব্যাংকে নগদ টাকায় টান পড়ায় বেড়ে গেছে ব্যবসায় ব্যয়। গুণগত বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটছে না। অর্থনীতির নেতিবাচক অবস্থার মধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন বছর। বিগত বছরের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর গতি অব্যাহত থাকলে নতুন বছরে সরকারকে অর্থনীতির নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা, উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন জোরদারকরণ এবং সর্বশেষ ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও কমিয়ে আনতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। দেশে ডলার সংকট এখনো কাটেনি। চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ঘোষণা দিয়ে আমদানি বাণিজ্যের লাগাম টানা হয়েছে। অর্থাৎ, সামষ্টিক অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়েছে। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট। এতে উৎপাদনও কম হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এলো নতুন একটি বছর। অনেকের মনেই প্রশ্ন- নতুন বছরের অর্থনীতি কেমন হবে? কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সমালোচনা হচ্ছে। টাকা পাচার ও ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিয়ে নানা ধরনের কথাও উঠছে। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়েও চলছে আলোচনা। বিদায়ি বছরের শেষ দিকে এসে সুখবর পেলো বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে, এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৮ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০তম বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ, আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই বিশ্বের ২০তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২৪’ নামের এই প্রতিবেদনটি প্রতি বছরের মতো এবারও ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মূলত সামনের বছর এবং আগামী ১৫ বছরে বিশ্বের কোন দেশের অর্থনীতি কী হারে বাড়বে, তারই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সিইবিআর পূর্বাভাস দিয়েছে, বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ এবং ২০২৭-২৮ সালের মধ্যে গড়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। অবশ্য পরবর্তী দশকে কমে প্রতি বছর গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। আগামী ১৫ বছরে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিলের (ডব্লিউইএলটি) র্যাঙ্কিংয়ে দ্রুত এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ২০৩৮ সালের মধ্যে টেবিলে ১৭ ধাপ উপরে উঠে আসবে, বর্তমান অবস্থান ৩৭তম। আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশ তিন ধাপ এগিয়ে যাবে এবং ২০৩৩ সালের মধ্যে ২৩তম স্থানে উঠে আসবে। প্রতি বছরের ২৬ ডিসেম্বর বিশ্ব অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করে সিইবিআর।