২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড়সহ বড় চারটি দুর্যোগেই প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। পরিমাণের দিক থেকে ৭.৮৪ লাখ টন ফসল এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ঠেকেছে ৭.৩১ লাখে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাব বলেছে, ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড়সহ বড় চারটি দুর্যোগেই প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। পরিমাণের দিক থেকে ৭.৮৪ লাখ টন ফসল এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ঠেকেছে ৭.৩১ লাখে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চারটি ঘূর্ণিঝড়সহ অন্তত ৯টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও দুই দফায় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপপ্রবাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আর এই দুর্যোগগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষিতে। ডিএই’র মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রণোদনা দিয়ে থাকি। তখন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিবেচনায় রাখি। কিন্তু একটা ঝড় হয়ে যাওয়ার পরপরই সেভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না সবসময়।’মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাঘাইকান্দি গ্রামের কৃষক মো. জসিম উদ্দিন তিন বিঘা জমিতে আলু রোপণ করেছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি চারা গজানোর আগমুহূর্তে গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে হওয়া বৃষ্টির পানি জমে বেশিরভাগ বীজ আলু জমিতে নষ্ট হয়ে যায়। মিধিলি কেটে যাওয়ার পর জসিম ফের জমি প্রস্তুত করে আলুর বীজ রোপণ করেন। কিন্তু মিধিলি উপকূলে আঘাত হানার মাত্র বিশ দিনের মাথায় আসে আরেক ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টানা দুই দিন বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টিতে আবারও জমিতে পানি জমে ৮০ শতাংশের বেশি বীজ পচে নষ্ট হয় জসিমের। জসিম বলেন, ‘দুই দফায় আলু চাষের পেছনে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এবারে আর চাষ করার মত সামর্থ্য আমার নেই।’ জসিম উদ্দিনের মতো ঘূর্ণিঝড়ে শুধু মুন্সিগঞ্জেই ১০ হাজার ৬০০ জনের বেশি কৃষকের আলুর আবাদ নষ্ট হয়েছে। ডিএই, কৃষক ও বিপণন ব্যবস্থায় জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, তার ফলে শীতকালীন সবজির সরবরাহে টান পড়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশে ১৫টি জেলায় ৩.৯৭ লাখ টন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আলু ও সবজির। ডিএইএর মিগজাউমের চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে উঠে এসেছে, ১.৯২ লাখ টন সবজি ও ১.৯২ লাখ টন আলুর উৎপাদন নষ্ট হয়েছে এই ঘূর্ণিঝড়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, দেশে গরমে যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয়, তার দ্বিগুণেরও বেশি সবজি উৎপাদন হয় শীতকালে। সে কারণে বরাবরই সবজির দাম শীতকালে সাধারণ মানুষেরন নাগালের মধ্যে থাকে এবং মানুষ খায়ও বেশি। মিগজাউমের তিন-চার দিন আগেও ভালো মানের বেগুন প্রতি কেজি ৪০-৫০ টাকা, আলুর কেজি ৫০-৬০ টাকা, শিমের কেজি ৪০-৩৫ টাকা, এবং ছোট আকারের ফুলকপির দাম ২৩ টাকায় নেমেছিল। কিন্তু গত এক মাসে এই দাম আবার বাড়তে বাড়তে আলু, শিম ও বেগুন ৭০-৮০ টাকা কেজি এবং ফুলকপি ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাকাগুলোর মধ্যে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদীর মতো জেলাগুলো রয়েছে, যেগুলো সবজি উৎপাদনে সবসময়ই ভালো অবস্থানে থাকে। বগুড়া, রংপুরের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু উৎপাদন হয় মুন্সীগঞ্জে। এই জেলায় এবার আলুর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১.৯২ লাখ টন ক্ষতিগ্রস্ত আলুর মধ্যে শুধু মুন্সিগঞ্জেই ক্ষতি হয়েছে ১.৮৭ লাখ টন আলুর। এছাড়া বোরো ধানের বীজতলা, গম, ভুট্টা, সরিষা, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচসহ নানা ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা জানান, বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ হতে শুরু করেছে, তার নমুনা বাংলাদেশে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এসব বিরূপ প্রভাবের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এল নিনো কন্ডিশন, যা সমুদ্রের তাপমাত্রা কমতে দিচ্ছে না। এ কারণে এবারে উষ্ণ শীতের পূর্বাভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। এল নিনো হলো সাউদার্ন অসিলেশন (ইএনএসও) নামক আবহাওয়ার ধরনের দুটি অংশ, যা ক্রান্তীয় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর বাতাসের ধরন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। এল নিনো বলতে ইএনএসওর উষ্ণায়ন পর্যায়কে বোঝায়। অন্যদিকে লা নিনা বোঝায় এর শীতলকরণ পর্যায়কে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, এ বছর অন্তত ৯টি লক্ষণীয় প্রভাব ছিল বাংলাদেশের আবহাওয়ায়। এর কারণ হলো এল নিনো। এল নিনো কন্ডিশন আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বজায় থাকতে পারে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এবং খাদ্য, কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক নীতি ও গবেষণায় যুক্ত এম আসাদুজ্জামান বলেন, এসব দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, সেটি মোটেও যথেষ্ট নয়।