নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ও খাদ্য লভ্যতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন সত্ত্বেও ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা বিধান সরকারের জন্য একটি গুরুত্ববহ বিষয় হয়ে থাকছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য উৎপাদনে তাৎপর্যপূর্ণ সফলতা অর্জন করেছে, যা বহুলাংশে জাতীয় পর্যায়ে অপ্রতুল খাদ্য লভ্যতার সমস্যা দূরীকরণে সহায়ক হয়েছে। পর্যাপ্ত খাদ্যের লভ্যতা নিশ্চিতকরণের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য হলেও জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট নয়। সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দরিদ্র ও দুস্থ পরিবারসমূহের জন্য খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষমতা ও সংগৃহীত খাদ্যের যথাযথ ব্যবহারে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। বিগত দশকে বাংলাদেশে খাদ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যেখানে চাল ও গমের বাজারে অধিকমাত্রায় সরকারি হস্তক্ষেপ কমিয়ে বাজারমুখী করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থাকে সুসংহত করে দরিদ্র ও দুস্থ পরিবারগুলোর জন্য অধিকতর লক্ষ্যমুখী করা হয়েছে। অধিকন্তু, খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যশস্যের লভ্যতা সন্তোষজনকভাবে বজায় থাকায় এবং পুষ্টিশিক্ষাসহ শিশু ও নারীর পুষ্টি উন্নয়নমুখী প্রচেষ্টাসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারের খাদ্যনীতির ব্যাপ্তি ক্রমেই প্রসার লাভ করেছে। বাংলাদেশের জীবনধারণোপযোগী গ্রামীণ অর্থনীতিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি মৌলিক খাদ্যের উৎপাদন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং চাষযোগ্য জমি হ্রাসের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। দেশে বিদ্যমান দারিদ্র্য ব্যবস্থায় উপরিউক্ত নিয়ামকসমূহ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা বিধানকে জটিল করে তুলেছে। দেশের শত শত পরিবার প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে লড়াই করছে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও জীবনযাত্রার ব্যয় তাদের সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষ। দেশের শত শত পরিবার প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে লড়াই করছে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও জীবনযাত্রার ব্যয় তাদের সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষ। বিশ্লেষকদের মতে, খাদ্যশস্যের অভাবে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা এজন্য দেশের দুর্বল বাজার ব্যবস্থাকেও দায়ী করেছেন। ২০২৩ সালের আগস্টে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ডাব্লিউএফপির জরিপে দেখা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা ৪৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার, নয় শতাংশ মধ্য-আয়ের পরিবার এবং তিন শতাংশেরও কম উচ্চ আয়ের পরিবার। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও চলতি বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। ২০১৮-২০২২ সালের মধ্যে দেশে ধানসহ খাদ্যশস্যের উৎপাদন চার বছরের গড় ৬ দশমিক ০৯ কোটি টন হওয়া সত্ত্বেও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে দেশের মোট ধান উৎপাদন রেকর্ড ৫ কোটি ৯০ লাখ কোটি টন হওয়ার পূর্বাভাস আছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তবে দেশের কৃষি বিপণনে দুর্বলতা আছে। তিনি বলেন, উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে যখন কোনো পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছায়, তখন এর দাম বহুগুণ বেড়ে যায়। সমস্যাটা সবাই জানে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, বলেন তিনি। তিনি সরবরাহ ও চাহিদার জন্য বাজার নিয়ে দরকারি তথ্যের ঘাটতিকেও দায়ী করেছেন। তিনি জানান, উৎপাদন ও বাজারের চাহিদার তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃষি বিপণন বিভাগকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। করোনা মহামারি ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষের আয় কমেছে, তাই তাদের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। যা নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজার ম্যানিপুলেটরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। তিনি মনে করেন, বাজার স্থিতিশীল করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র পরিচালিত ওএমএস কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য হলো, ক্রমবর্ধমান খাদ্যপণ্যের দাম যেন নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর না পড়ে। রাজধানীর ১১০টি স্থানসহ সারা দেশে ৯৬৪টি ওএমএসের দোকান পরিচালনা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যারা মুদি দোকান বা কাঁচাবাজারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে চাল এবং আটা বিক্রি করে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, বন্যার মতো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া বাংলাদেশে খাদ্য অভাবের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে, বাণিজ্যনীতিসহ বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে যে কোনো পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তাই হঠাৎ করে কোনো পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে সরকারকে সজাগ থাকার পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, সেক্ষেত্রে কাঁচাবাজারে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দেখা দিলে সরকার আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ ঘাটতি পূরণ করতে পারে। রংপুরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমলেও এখনো এ অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অঞ্চলটির প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে, যেখানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার জাতীয় গড় ২১.৯১ শতাংশ। রবিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা ‘ফুড সিকিউরিটি স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ শীর্ষক এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের ৮টি বিভাগের ২৯ হাজার ৬০টি পরিবারের ওপর এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপের তথ্যমতে, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এমন মানুষের শতকরা হার ০.৮৩ শতাংশ। আর মাঝারি ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২১.৯১ শতাংশ (এর মধ্যে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তার হারও অন্তর্ভুক্ত)। এদিকে, বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে এটি ছিল ২৪.৩ শতাংশ। মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা সংচেয়ে বেশি রংপুরে ২৯.৯৮ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে সিলেট, যেখানে ২৬.৪৮ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ২৫.০১ শতাংশ, বরিশালে ২২.৮৩ শতাংশ, খুলনায় ২২.০৭ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৯.৬৬ শতাংশ এবং ঢাকায় ১৬.৪০ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। যদিও বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী উচ্চ ও নিম্ন দারিদ্র্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বরিশাল বিভাগ, যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৬.৯ শতাংশ। অন্যদিকে, রংপুরে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র ছিল ২০১৬ সালে, ৪৭ শতাংশ। এটি এখন কমে ২৪.৮ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ দারিদ্র্যের হার রংপুরে কমলেও এখনো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কমেনি। খানা জরিপে প্রতি ৫ জন মানুষের একজন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।