নির্বাচনের পর ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি
* আইএমএফ’র ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দুটি কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ * ডিসেম্বর মাসে দেশে ১৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
দীর্ঘদিন ধরে দেশে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া নানা উদ্যোগের পরও সংকট আরো বেড়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বর মাসে দেশে ১৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। সদ্য বিদায়ি ডিসেম্বর মাসে ছয় মাসের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহে গতি বেড়েছে। রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনও ঠেকানো গেছে। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অর্থনীতিতে আরও গতিসঞ্চার হতে পারে। ভোটের পর থেকে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিগত নির্বাচনি বছরগুলোতে দেখা গেছে, সব সরকারকেই নির্বাচনি বছরে প্রবৃদ্ধি কমার শঙ্কা তাড়া করেছে। এ বিষয়ক অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ বলছে, প্রায় সব নির্বাচনি বছরেই প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ ২.৬ শতাংশ থেকে ০.৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ফলে চলমান বৈশ্বিক সংকট ও অভ্যন্তরীণ কঠিন বিশ্ব বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে নতুন বছরে অর্থনীতির যাত্রাপথে সম্ভাবনার পরিবর্তে অনিশ্চয়তাই বেশি অনুভূত হচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী নেতাদের আশঙ্কা, এই সময়ে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার, স্থিতিশীলতা রক্ষা কিংবা গতিশীলতা বাড়ানোর উদ্যোগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা। এর বাইরে দেশে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি, সামষ্টিক অর্থনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের মতো উদ্বেগজনক বিষয়গুলো তো রয়েছেই। তাদের এই আশঙ্কাও অমূলক নয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থনীতিবিষয়ক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক থেকেও নতুন বছরের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে ভর্তুকি, মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স, ডলারের বিনিময় হার এবং জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে। অন্যদিকে, বিগত নির্বাচনি বছরগুলোতে দেখা গেছে, সব সরকারকেই নির্বাচনি বছরে প্রবৃদ্ধি কমার শঙ্কা তাড়া করেছে। এ বিষয়ক অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ বলছে, প্রায় সব নির্বাচনি বছরেই প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ ২.৬ শতাংশ থেকে ০.৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঋণাত্মক সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। গবেষণায় দেখা গেছে, কেনিয়ায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে পূর্বে এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনেক বেড়েছে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা কি না ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৮৮ শতাংশ। কোভিড-১৯ চলাকালীন ২০১৯-২০ প্রবৃদ্ধির হার কমে ৩.৪৫ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬.৯৪ শতাংশ এবং ৭.১০ শতাংশে। বাংলাদেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতির হার ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ছিল ৮.৮৫ শতাংশ, যা কি না ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে এসে দাঁড়ায় ৯.৪৯ শতাংশে। এ বছর দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকায় সংশোধিত বাজেটে সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে সাত শতাংশ থেকে কমিয়ে সাত শতাংশ করেছিল। অবশ্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পূর্বাভাস ছিল, বিদায়ী বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না। তবে আইএমএফের হিসেব অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত প্রায় সব পণ্যের চড়া দাম পরিশোধ করতে হওয়ায় সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায়, যার পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ পড়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। একদিকে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য অনেক বেড়ে গেছে, অন্যদিকে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার মতো অপরিহার্য ব্যয় থেকে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ। টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ কিছুটা কাজে দিলেও ডিম, পেঁয়াজ, আলুর মত নিত্যপণ্য আমদানির ঘোষণা বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বিদায় নেওয়া বছরটি ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির বছর। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দুটি কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। নতুন বছরে আরও দুই কিস্তি ঋণ পাওয়ার কথা। এই ঋণ পেতে ২০২৩ সালে শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হয়েছে। তবে আরও অনেক বেশি শর্ত পূরণ করতে হবে ২০২৪ সালে। এর মধ্যে রয়েছে করছাড় কমানো, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়, ভর্তুকি যৌক্তিক করা, খেলাপি ঋণ হ্রাস, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের তালিকা নিয়মিত প্রকাশ, ব্যাংক খাতের তদারকিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি সুদহারের কাঠামো ঠিক করা; রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি কমানো, ইত্যাদি।