রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে হাঁস

দেশে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বাজার

প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

একসময় শহরে হাঁসের মাংসের বেচাকেনা তেমন চোখে পড়ত না। হাঁসের মাংস ও ডিম দুটোরই দেখা মিলত শুধু গ্রামে। কিন্তু গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। শীতের মৌসুম আসতেই শহরের বাসাবাড়ি তো বটেই, ভাতের ছোট হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁয় হাঁসের মাংসের চাহিদা বেড়ে যায়। কখনো কখনো শীত উদযাপনে পিঠাপুলি আয়োজনেও অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে ‘হাঁস পার্টি’। সব মিলিয়ে দেশে দিন দিন হাঁসের মাংসের বাজার দ্রুত বাড়ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে হাঁসের সংখ্যা প্রতি বছরই বেড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে হাঁস উৎপাদন হয়েছিল ৪ কোটি ৮৯ লাখ, যা সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি ৬০ লাখে। সেই হিসাবে ১০ বছরে হাঁস উৎপাদন ১ কোটি ৭১ লাখ বা ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। বাণিজ্যিকভাবে হাঁস উৎপাদন বেশি হয় দেশের হাওরাঞ্চলে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরাঞ্চলেও চাষ বাড়ছে। শীত মৌসুমে হাঁস বেচাকেনা অন্তত পাঁচগুণ বাড়ে। ঢাকায় এখন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ট্রাক করে হাঁস আসছে। শীত বাড়লে সংখ্যাটা আরো বাড়বে। ব্যবসাটা মৌসুমি হলেও বছরের অন্য সময়েও হাঁস মোটামুটি বিক্রি হয়। শীতের এই সময়টায় হাঁসের মাংস বিক্রি হয় বেশ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাহিদা মেটাতে থাকে নানা আয়োজন। মৌসুমি লোভনীয় এই খাবারের ব্যবসা ও বাজার ক্রমশই বড় হচ্ছে। এতে আয়ের পথ খুঁজে পাচ্ছে বহু পরিবার। যাপিত জীবনে শীতের আগমনে ধুম পড়ে সৌখিন উদযাপনের। বিশেষ করে চলে হাঁসের মাংসের ভোজ। ফলে এর চাহিদাও বাড়ছে দিনকে দিন। আর তা কাজে লাগিয়ে উপার্জনের উৎস খুঁজে নিয়েছেন অনেকেই। রাজধানীর পূর্বাচল নীলা মার্কেট-সংলগ্ন মূছা মীর জামাই-বউ হোটেলের স্বত্বাধিকারী মো. মুছা বলেন, ‘সারা বছর হাঁসের মাংস বিক্রি করি। তবে শীত আসলে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ কেজির মতো মাংস বিক্রি করতে পারি। বছরের অন্যান্য সময় যা এর অর্ধেকের কম হয়। প্রতি বাটি হাঁসের মাংসের দাম রাখি ২০০ টাকা।’ পূর্বাচলের বাবুল মোল্লা। স্ত্রীকে নিয়ে ৬ বছরের বেশি সময় ধরে চালাচ্ছেন একটি দোকান। শীতের শুরু থেকে দৈনিক ১৫ থেকে ২০টি হাঁসের মাংস বিক্রি হচ্ছে এখানে। প্রতি প্লেটের দাম ২৫০ টাকা। বাবুল বলেন, গ্রাম থেকে হাঁস আসে। পাইকারে দিয়ে যায়। পরে পরিষ্কার করে রাত ৩টা থেকে রান্না শুরু করি। বাবুলের স্ত্রী বলেন, বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিক্রি করি। হাঁসের মাংসের সঙ্গে চাপটি, চিতই পিঠাও বিকোচ্ছে। রাজধানীর অদূরে পূর্বাচলের বালু নদীরপাড়ে শতাধিক পরিবার আয় করছেন রান্না করা হাঁসের মাংস বিক্রি করে। যার স্বাদ নিতে বন্ধু-স্বজন নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসছে বহু মানুষ। এক ক্রেতা বলেন, শীতে হাঁসের মাংস একটু ঝাল করে রান্না করলে অন্যরকম স্বাদ লাগে। আরেকজন বলেন, বাসা আর এখানকার রান্নার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এজন্য ছুটির দিনে সবাই মিলে উপভোগ করতে আসি। এক বিক্রেতা বলেন, আশপাশের লোকজন এখানে আসে। ঢাকা শহরের প্রায় লোক আসে। আগে তারা এখানে ঘোরাফেরা করে। আড্ডা দেয়, পরে খায়। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁসের সরবরাহ বাড়ছে ঢাকার বাজারগুলোতে। মানভেদে একেকটি পাতিহাঁস বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আর চীনা ও রাজহাঁসের দাম হাজার টাকার ওপরে। এক বিক্রেতা বলেন, শীত এলে বাঙালিদের মধ্যে হাঁস খাওয়ার হিড়িক পড়ে। যে কারণে চাহিদা বেশি থাকে। এতে দামও বেশি। অপর বিক্রেতা বলেন, এখন শীতকাল, তাই বেচাকেনা বেশি। ভালো চলছে সবকিছু। সরকারি হিসাবে, গেল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে হাঁসের উৎপাদন ছিল ৬ কোটি ৬০ লাখ পিস। একেকটির দাম গড়ে ৫০০ টাকা দরে হিসাব করলে হাঁসের বাজার দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। দেশের বাজারে হাঁসের মাংসের পাশাপাশি এর ডিমের চাহিদাও বাড়ছে। তবে মাংস রপ্তানিতে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারি হিসাবে, গত ২০-২২-২৩ অর্থবছরে যত হাঁস উৎপাদিত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির দাম ন্যূনতম ৫০০ টাকা ধরে হিসাব করলে বছরে হাঁসের বাজার দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হাঁসের মাংস ও ডিমের বাজারে দৃশ্যত বেশ বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। তাতে সরকারি হিসাবের চেয়েও হাঁসের বাজার আরো বড় বলে মনে করেন খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে হাঁসের বাণিজ্যিক খামার আছে ১০ হাজারের বেশি। হাঁসের ব্যবসা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ডিমের বাজারও বড় হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শহরে হাঁসের মাংস বিক্রির প্রবণতা শুরু হয়েছে মূলত ২০১৫ সালের দিকে। সারা বছর কমবেশি বিক্রি হলেও, বেশি চাহিদা থাকে শীত মৌসুমে। এ সময় বেচাকেনা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। ঘরোয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শীতের পিঠার সঙ্গে খেতেও হাঁসের মাংসের চাহিদা আছে। চুইঝাল দিয়ে রান্না করা হাঁসের মাংসও খেতে পছন্দ করেন অনেকে। বাণিজ্যিকভাবে পালন করা হাঁসের বড় অংশ ‘পাতিহাঁস’। এই হাঁসের আবার নানা ধরন আছে। তবে বাজারে পাতিহাঁসের পাশাপাশি রাজহাঁস ও চিনাহাঁসের চাহিদাও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে শীতকাল এলে সব জাতের হাঁসই বিক্রি হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাঁসের মাংসের বাজারটা চাঙা থাকে আড়াই থেকে তিন মাস। বড় বেচাকেনা শুরু হয় নভেম্বরের মাঝামাঝি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে মৌসুম শেষ হয়ে আসে। ঢাকার বাজারে এখন দেড় কেজি ওজনের প্রতিটি জীবন্ত পাতিহাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। ১ কেজির বেশি ওজনের পাতিহাঁসের দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। সুপারশপগুলো ড্রেসিং করা প্রতি কেজি পাতিহাঁসের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা নেয়। আর জীবন্ত রাজহাঁস ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা ও চিনাহাঁস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে দাম কিছু কমবেশিও হতে পারে। বিক্রেতারা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার হাঁসের দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। সুপারশপ ও অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ড্রেসিং করা ও রান্নার উপযোগী করে রাখা হাঁস পাওয়া যায়। বাজার থেকেও হাঁসের পালক ছাড়ানোর সুযোগ থাকে। তাতে আকারভেদে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ১০০ টাকার মতো। শুধু হাঁস নয়, বাজারে হাঁসের ডিমের চাহিদাও বেশি। হাঁসের ব্যবসা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমের বাজারটিও বড় হয়েছে। কারণ, আগের তুলনায় এখন হাঁসের ডিম সহজেই মিলছে বাজারে। শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রাজধানীতে বেড়েছে হাঁস, মুরগি ও কবুতরের মাংসের চাহিদা। বিশেষ করে, সপ্তাহের ব্যবধানে হাঁসের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০০-১৩০ টাকা। রাজধানীতে মোটাদাগে তিনটি স্থানে হাঁসের পাইকারি বেচাকেনা হয়- মোহাম্মদপুর-বছিলা বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন সাদেক খান মুরগির বাজার, কাপ্তানবাজার আড়ত ও এফডিসি-সংলগ্ন ঢাকা মহানগর হাঁস-মুরগির আড়ত। এর মধ্যে শীত মৌসুমে প্রতিদিন সাদেক খান মুরগির বাজারে বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার, কাপ্তানবাজারে আড়াই থেকে তিন হাজার এবং এফডিসি-সংলগ্ন ঢাকা মহানগর হাঁস-মুরগির আড়তে চার থেকে পাঁচ হাজার হাঁস বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে। ঘরোয়া আয়োজনের পাশাপাশি রেস্তোরাঁ ও অনলাইন থেকেও রান্না করা হাঁসের মাংস খাচ্ছেন অনেকে। গত অর্থ বছরে বাজার ছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার।