খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে সারা বিশ্বে, দেশে রেকর্ড বৃদ্ধি

প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে চাকরি করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। মাসে বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। স্ত্রী, দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার। বাসাভাড়া, সংসার খরচ, সন্তানদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ চালাতে গিয়ে প্রতি মাসেই তাকে কিছু ধারদেনা করতে হয়। আবদুল্লাহ আল মামুন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গত এক বছরে সংসার খরচ ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এই খরচ সামাল দিতে বাজারের ফর্দে অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে। আগে সপ্তাহে এক দিন মাংস খেতাম। এখন দুই সপ্তাহে একবার খাই। দেশে ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতিতে দুটি রেকর্ড হয়েছে। একটি সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে, অপরটি খাদ্যের মূল্যস্ফীতিতে। এ বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতির উত্তাপ সবচেয়ে বেশি ছিল। ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছে, যা গত ১৩৪ মাস বা ১১ বছর দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল সার্বিক মূল্যস্ফীতি। খাদ্যের মূল্যস্ফীতিও এবার গত এক দশকের মধ্যে রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত আগস্টে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে ওঠে, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যায়। তা মূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। দেশে টানা ৯ মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এটাকে বেশ উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে ওঠে। পরের মাসে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে উঠে যায়। এরপর আর ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। ৯ শতাংশের ওপরেই ওঠানামা করছে। সর্বশেষ গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে মানুষের তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে গত দেড় বছর মূল্যস্ফীতির চেয়ে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাস থেকে প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এর চেয়ে কম হারে মজুরি বেড়েছে। গত বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতিকে আর ধরতে পারেনি। এ বছরের নভেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এর মানে হলো মজুরি যত বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হিসাব পাওয়া গেছে। এই ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তার মানে হলো ২০২২ সালে একজন মানুষের যাবতীয় খরচ যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৪৮ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৪৮ পয়সা। এখন কোনো পরিবারের যদি ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকা বাজার খরচ হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৪৪ টাকায়। প্রতি মাসে খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৮৪৪ টাকা। এটি সারা দেশের গড় হিসাবের চিত্র। মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ গরিব মানুষকে বেশি ভুগিয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ ২০ শতাংশের ওপরে। এর মানে একটি গরিব পরিবারের খরচ এক-পঞ্চমাংশ বেড়ে গেছে। কারও কারও ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি। কারণ, চাল, ডাল, চিনি, আটা-ময়দা, শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, পেঁয়াজসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এগুলো কিনতেই স্বল্প আয়ের মানুষের আয়ের সিংহভাগ চলে যায়। আভিধানিকভাবে ‘সমন্বয়’ কথাটি দিয়ে যা-ই বোঝানো হোক, বাংলাদেশে ‘মূল্য সমন্বয়’ বলতে সম্ভবত শুধু মূল্যবৃদ্ধি-ই বোঝানো হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়, তখন তার সঙ্গে ‘সমন্বয়’ করে দেশে ওই পণ্যের দাম বাড়ানো হয় ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন পণ্যের দাম কমে, তখন তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বাজারে সেই পণ্যের দাম কমতে দেখা যায় না। ২০২৩ সাল। বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতিতে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠলেও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) বলছে, ২০২২ সালের তুলনায় বিদায়ি বছর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম গড়ে কমেছে ১০ দশমিক ১ শতাংশ। এমন চিত্রই উঠে এসেছে শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) প্রকাশিত সংস্থাটির মাসিক প্রতিবেদনে। যুদ্ধের বছর ২০২৩ সালজুড়েই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চড়া মাশুল গুনেছে বিশ্ববাসী। তারপরও ২০২৪-এর শুরুতেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে গড়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ২০২৩ সালে বিগত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে ভোজ্যতেলের দাম। গত বছর মোটের ওপর এই তেলের দাম কমেছে ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের শুরুতে ভোজ্যতেলের মূল্য সূচক ছিল ১৪৪ দশমিক ৬ পয়েন্টে। বছরজুড়েই দাম কমতির ধারাবাহিকতায় এই সূচক গত ডিসেম্বরে নেমেছে ১২২ দশমিক ৪ পয়েন্টে। ব্রাজিলে ভালো উৎপাদনের সুফল মিলেছে চিনির বিশ্ববাজারে। এক মাস আগের তুলনায় গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমেছে সাড়ে ১৬ শতাংশের বেশি। মূল্য সূচক দাঁড়িয়েছে ১৩৪ দশমিক ৬ পয়েন্টে। বলা হচ্ছে, গত মার্চের পর পণ্যটির দাম বিশ্ববাজারে এটাই সবচেয়ে কম। যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় এখনও বৈশ্বিক বাজারে চিনির দাম প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। শুধু তাই নয়, বিশ্ববাজারে চিনির দাম ২০১১ সালের পর বর্তমানে রয়েছে সর্বোচ্চে স্তরে। মাসিক ব্যবধানে গতমাসে বিশ্ববাজারে মাংসের দাম কমেছে ১ শতাংশ। দামের উত্থান-পতনে বছর শেষে এক বছর আগের তুলনায় এই পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। চাল, গম, যবসহ দানাদার খাদ্যের দাম নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে কিছুটা বাড়লেও, ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর এসব খাদ্যপণ্যের দাম গড়ে কমেছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। মূলত বিশ্বব্যাপী ভালো সরবরাহ থাকায় এ সুফল মিলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে গত বছরের আগস্টে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় সরকার। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই দাম ‘সমন্বয়’ করতে হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে। একবারে জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন এমন মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এ কারণে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়েছে।