করোনাভাইরাস মহামারির পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর ডলার সঙ্কট দেখা দেয় দেশে। আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ভোগান্তিতে পড়েন ব্যবসায়ীরা। ডলার সঙ্কট কাটাতে বিলাসী পণ্য আমাদানি নিরুৎসাহিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে, জরুরি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ডলার সঙ্কট কাটাতে প্রবাসী আয় বাড়ানোর নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসবের সুফল মিলছে। আমদানি ব্যয় কমে আসায় বাণিজ্য ঘাটতিও অনেকটা কমেছে। ডলার-সংকটের কারণে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে কমেছে দেশের বিদেশি লেনদেনের ঘাটতি। নভেম্বর পর্যন্ত ৪৭৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় প্রতি এক ডলার ১০৯ টাকা ধরে যার পরিমাণ ৫১ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশের পণ্য আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৫৭২ কোটি ডলারের। একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৯৬ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ৪৭৬ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৫৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। একটি দেশের আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের পার্থক্যকে বাণিজ্য ঘাটতি বলে। প্রতি তিন মাস পর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৫৭২ কোটি মার্কিন ডলারের। একই সময়ে দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৯৬ কোটি ডলারের। এতে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৪৭৬ কোটি ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাণিজ্যে ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৮২ কোটি ডলার। বছরের ব্যবধানে বাণিজ্যে ঘাটতি কমেছে ৫৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যখন ডলার সঙ্কট দেখা দেয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসদ্রব্যসহ বেশকিছু পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করে। এ নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভূমিকা রেখেছে। শুধু, আমদানি কমলেই হবে না, অন্যান্য সূচকেও নজর দিতে হবে বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি কোনো আমদানিকারক যেন পণ্যের বাড়তি দাম দেখিয়ে আমদানি করতে না পারে সেদিকেও রয়েছে কঠোর নজরদারি। ‘প্রতিটি ব্যাংককে আমরা সতর্কতার সঙ্গে আমদানির ঋণপত্র খুলতে বলেছি। আমদানিতে যেন কোনোভাবেই কোনো মিথ্যা তথ্য না আসে সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর নজরদারি করছে। শুধু তাই নয়, আমদানির আড়ালে যেন কোনোভাবেই অর্থ পাচার না হয় সেদিকেও আমাদের নজরদারি রয়েছে।’ তিনি জানান, বর্তমানে বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। এছাড়া দাম বাড়তি মনে হলে তা সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে। এজন্য আমদানি কিছুটা কমে এসেছে। আমদানি কমানোর প্রবণতা অব্যাহত থাকবে কিনা- এমন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা কোনো ভুল দামে পণ্য আমদানি করতে দেবে না। আমার মনে হয় এতে আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ঘাটতি কমে আসবে।’কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি কমে ৩ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এটা ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ছিলো ১ হাজার ৭১৫ কোটি ডলার বা ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি দেখা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরে। করোনা মহামারি শুরুর প্রথম বছরে বাণিজ্য ঘাটতি সব রেকর্ড ভেঙে ছাড়িয়ে যায় ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলারের ঘর। সে হিসাবে গত অর্থবছরে তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় অর্ধেক হয় বাণিজ্য ঘাটতি। চলতি অর্থবছর শেষে তা আরও কমে আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তবে এর প্রভাবে যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমে না আসে সেদিকে নজর দেয়ার পরামর্শ তাদের। অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বাণিজ্য ঘাটতি বাড়লে রিজার্ভে চাপ পড়ে। এ কারণে অকেটা আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো হয়েছে। শুধু আমদানি কমালে হবে না। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট কম রাখাসহ সব সূচকেই নজর রাখতে হবে। এদিকে, বাণিজ্য ঘাটতি কমায় চলতি হিসাব এখন উদ্বৃত্তে আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৮ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫৬৭ কোটি ডলার। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে ঋণ করতে হচ্ছে না। তবে, ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। তাই, উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৮৮১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৮৭৯ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য বলছে, গেল চার মাসে বাণিজ্য ঘাটতি কমে হয়েছে ৩৮০ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিলো ৯৬২ কোটি ৪০ লাখ ডলার।