ব্রাসেলস, বার্লিন, বার্সেলোনা। অথবা ধরা যাক ডালাস, দিল্লি বা দোহা। জীবনযাত্রার ব্যয় হিসেব করলে এসব নগরীর তুলনায় ঢাকা নগরীর অবস্থান কোথায়? অন্তত বিদেশিদের জীবনযাত্রার খরচ যদি ধরেন, তাহলে ঢাকা নগরী এদের সবার উপরে, অর্থাৎ ঢাকা অনেক বেশি ব্যয়বহুল নগরী। গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৩ সালের ১৭৩টি শহরের মধ্যে জিম্বাবুয়ের হারারে’র সঙ্গে যৌথভাবে ১৬৬তম অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এটি সূচকে সপ্তম সর্বনিম্ন বাসযোগ্য শহর হিসেবে অবস্থান করছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক থেকে টরন্টো, ক্যালগারি, মন্ট্রিল ও লিসবনের মতো শহরগুলোর কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। গত নভেম্বরে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে তাদের সর্বশেষ জরিপ প্রকাশ করে।
এই জরিপের জন্য, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ১৭৩ টি শহরের ২০০টিরও বেশি পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর ৪০০-এরও বেশি স্বতন্ত্র মূল্যের তুলনা করেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরের তালিকার প্রথমে রয়েছে সিঙ্গাপুর (সূচক মান ১০৪)। আর সবার শেষে অর্থাৎ সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল শহর হল সিরিয়ার দামেস্ক (সূচক মান ১৩)। আর জরিপে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সূচক মান ৫৬। গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৩-এ ১৭৩টি শহরের মধ্যে জিম্বাবুয়ের হারারে’র সঙ্গে যৌথভাবে ১৬৬তম অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এটি সূচকে সপ্তম সর্বনিম্ন বাসযোগ্য শহর হিসেবে অবস্থান করছে। তবে দামেস্ক কম ব্যয়বহুল শহর হলেও বিশ্বব্যাপী বসবাসযোগ্যতার র্যাংকিংয়ে নিচে অবস্থান করছে (১৭৩তম স্থান)। অপরদিকে ঢাকা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল শহর ঠিক তেমনি বসবাসেরও অযোগ্য। আগের বছরের সূচকে ঢাকা নিচের দিক থেকে সপ্তম স্থানে অবস্থান করেছিল। বাসযোগ্য শহরগুলো পাঁচটি দিক বিবেচনা করে পরিমাপ করা হয়েছে। সেগুলো হলো, স্থায়িত্ব, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো। তবে ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য বেশ কয়েকটি শহর রয়েছে যা খুব ব্যয়বহুল এবং বাসযোগ্যতা সূচকে নিচে অবস্থান করছে। উদাহরণস্বরূপ, হংকং বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে পঞ্চম ব্যয়বহুল শহর। কিন্তু বাসযোগ্যতা সূচকে এটি ৯২ তম অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, কানাডার ক্যালগারি ১৪৫ তম ব্যয়বহুল শহর হলেও বাসযোগ্য শহরের তালিকায় সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, শুধু জীবনযাত্রার উচ্চব্যয়ের ওপর নয়, একটি শহর বাসযোগ্য হবে কি না- তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। অধ্যাপক আদিলের মতে, জীবনযাত্রার কিছু সূচক রয়েছে। যেমন : উন্নত পরিবহনে চলাচল, সাশ্রয়ী মূল্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা, ট্র্যাফিক ঘনত্বের পাশাপাশি আবাসন, খাদ্য, শিক্ষা এবং সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বাংলাদেশের যে অর্থনীতি, মানুষের যে গড়পড়তা আয়, এবং ঢাকা শহরের যে ধরনের দুর্বল অবকাঠামো এবং বিনোদন সুবিধা, সেখানে ঢাকা যে বিদেশিদের জন্য এতটা ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে, তা অনেকের কাছেই অবাক লাগবে। আবাসন, পরিবহনের খরচ বেশি সেটা নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় আরও যেসব জিনিসের দাম বিবেচনায় নিয়ে এই সূচক তৈরি, সেটার দামও কি ঢাকায় বেশি? বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত এবং পিছিয়ে থাকা অর্থনীতির একটি দেশের রাজধানী শহর কেন এতটা ব্যয়বহুল? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে এক নজরে দেখে নেয়া যাক ব্যয়বহুল নগরীগুলোর তালিকায় কাদের অবস্থান কোথায়। মার্কার ব্যয়বহুল নগরীর এই সূচক তৈরি করে কোন নগরীতে বিদেশিদের জীবনযাত্রার খরচের তুলনা করার জন্য। মোট দুশটি আইটেমের ব্যয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এর মধ্যে আছে বাসস্থান, যাতায়ত, খাবার, বিনোদন থেকে শুরু করে নানা কিছুর দাম। এক কাপ কফি, এক বোতল পানি, এক লিটার পেট্রোল বা এক লিটার দুধ। মানদন্ড হিসেবে ধরা হয় নিউ ইয়র্ক নগরীকে। আর খরচের হিসেব তুলনা করা হয় মার্কিন ডলারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “শুধু জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের ওপর নয়, একটি শহর বাসযোগ্য হবে কি-না তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।”অধ্যাপক আদিলের মতে, জীবনযাত্রার কিছু সূচক রয়েছে। যেমন, উন্নত পরিবহণে চলাচল, সাশ্রয়ী মূল্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা, ট্র্যাফিক ঘনত্বের পাশাপাশি আবাসন, খাদ্য, শিক্ষা এবং সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তিনি বলেন, যখন আমরা বলি যে, একটি শহরের জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় রয়েছে, এর অর্থ শহরটি তার জনসংখ্যার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের জন্য অত্যন্ত অসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আয়ের স্তরের বৈষম্যের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম খারাপ অবস্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে কানাডার মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৫৪, ৯৬৬ মার্কিন ডলার। যেখানে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপি ২, ৫২৮ ডলার। নয়াদিল্লির ভালো অবকাঠামো রয়েছে। দূষণের কারণে এটি বিশ্বের ২৫ তম ব্যয়বহুল শহর এবং ২০২৩ সালে বাসযোগ্যতা সূচকে ১৪১ তম। বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত এবং পিছিয়ে থাকা অর্থনীতির একটি দেশের রাজধানী শহর কেন এতটা ব্যয়বহুল?