ছোট ব্যবসার বড় অবদান
অর্থনীতির প্রাণ সিএমএসএমই খাত
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
কোনো কিছুই একেবারে ফেলনা নয়। যেমন ফেলনা নয় ফেলে দেওয়া নোংরা-ময়লা কাগজের কার্টনও। এসব ময়লা কাগজের কার্টন থেকে মণ্ড তৈরি করে পরে সেখান থেকে কাগজের কোন বানিয়ে সফল হয়েছেন এক উদ্যোক্তা। যদিও স্থানীয়ভাবে এই কোনকে ববিন বলা হয়। আর এই কোনে পেঁচিয়েই দেশে-বিদেশে যায় সোনালি আঁশ পাটের সুতা। যশোরের আবুল কালাম নামের এক উদ্যোক্তা ফেলে দেওয়া কার্টন থেকে পাট সুতার কোন তৈরি করেন। সরাসরি রপ্তানিকারক না হলেও আবুল কালামের কোন প্রচ্ছন্নভাবে রপ্তানি হয়। ফেলনা কার্টন পুনর্ব্যবহার করে তা থেকে পণ্য তৈরির মাধ্যমে উদাহরণ স্থাপন করেছেন স্বল্পি শক্ষিত আবুল কালাম। খুলনা-যশোর অঞ্চলে একমাত্র কালাম প্যাকেজিং নামের প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের কোনো তৈরি করে। যশোরের ঝুমঝুমপুরের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নগরীতে ছোট্ট একটি কারখানা রয়েছে তার। এ কারখানায় প্রতি সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোন তৈরি হয়। প্রায় ৫০ জন কর্মী সেখানে কাজ করেন। সংসারের কাজের ফাঁকে শখের বশে ব্লক বুটিকের কাজ করতেন দেলোয়ারা বেগম। নিজ বাড়ীতেই ব্লক বুটিক শেখার প্রশিক্ষণ দেন আশপাশের নারীদের। শৈল্পিক এ কাজের নেশা কখন যে পেশায় পরিনত হয়েছে বুঝতেই পারেননি তিনি। ব্লক বুটিকের সাথে যোগ হয় হস্ত শিল্পের। আজ হস্তশিল্পের সফল উদ্যোক্তা তিনি। মিলেছে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতি। এই সফল নারী উদ্যোক্তার বাড়ি শহরের বকুলতলা এলাকায় মাদ্রাসা রোডের দীপ্ত কুটিরে। উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে প্রাণশক্তি বিবেচনা করা হয় সিএমএসএমই খাতকে। উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবলম্বন তৈরি এবং শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি- সব ক্ষেত্রেই অনস্বীকার্য অবদান রেখে যাচ্ছে সিএমএসএমই খাত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং মানুষের ভাগ্য বদলে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে ২০২৩ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ৬২ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) তুলনায় ১৩ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। প্রথম প্রান্তিকে ঋণ বিতরণ হয় ৪৯ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সিএমএসএমই খাতে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৫৯৪ জন গ্রাহকের অনুকূলে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৬২ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ৫৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। তবে গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে ৪৯ হাজার ৬৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, যা তার আগের প্রান্তিকের তুলনায় ১১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ০৪ শতাংশ কম। ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৬১১ কোটি টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসএমই খাতের ৬৬ হাজার ৭৫৫ জন নতুন উদ্যোক্তার মাঝে ৯ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো। পল্লী এলাকার ৮৭ হাজার ৬২টি এসএমই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিতরণ করা হয় ১৪ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার ঋণ। আলোচিত সময়ে জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয় ৮ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা।
এর মধ্যে কুটির (কটেজ) প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ৮১ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। মাইক্রো খাতের প্রতিষ্ঠানে ৯ হাজার ২৬০ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র শিল্পে ৩৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা এবং মাঝারি শিল্প খাতে ১৫ হাজার ২১২ কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো। তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সিএমএসএমই খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করে ৩২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বিতরণ করে ৮ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংক বিতরণ করে ১ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। ইসলামিক ব্যাংকগুলো বিতরণ করে ১৬ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংক বিতরণ করে ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করে ২ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। সিএমএসএমই যারা : কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে গঠিত সিএমএসএমই খাত। সংজ্ঞায়ন অনুযায়ী যেসব পণ্য ছোটখাটো কোনো ঘরের মধ্যে তৈরি করা হয় সেগুলোই কটেজ বা কুটির শিল্প। এতে অনেক বড় মেশিনের ব্যবহার করা লাগে না। যেমন- তাঁত, মৃৎ, কাঁসা, কাঠ, হস্তশিল্প। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিপুলসংখ্যক কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা রয়েছেন। মাইক্রো বা অতিক্ষুদ্র শিল্প হচ্ছে উৎপাদনমুখী যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য যন্ত্রপাতি স্থাপন ব্যয়সহ ১০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকার মধ্যে। এতে শ্রমিক থাকবে একজন থেকে ২৫ জন পর্যন্ত। স্মল বা ক্ষুদ্র শিল্প হচ্ছে উৎপাদনমুখী পণ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য যন্ত্রপাতি স্থাপন ব্যয়সহ ৭৫ লাখ থেকে ১৫ কোটি টাকার মধ্যে থাকবে। এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন ২৬ জন থেকে ১২০ জন শ্রমিক। মিডিয়াম বা মাঝারি শিল্প হচ্ছে উৎপাদনমুখী যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি, কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য যন্ত্রপাতি স্থাপন ব্যয়সহ ১৫ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার মধ্যে হবে। যেখানে কাজ করবেন ১২১ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক। তবে তৈরি পোশাকের প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ এক হাজার জন।
শিল্প ও কর্মসংস্থান : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩-এর পর আর নতুন কোনো তথ্য নেই। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে সব খাত মিলিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৭.৫২ শতাংশ কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান।
অতি ক্ষুদ্র ১০.৯৯ শতাংশ, ক্ষুদ্র ১.৩৩ শতাংশ, মাঝারি ০.০৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম ০.০৭ শতাংশ বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। সব খাত মিলিয়ে কর্মসংস্থান হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ ৮৫০ জনের। এর মধ্যে সিএমএসএমই কর্মরত রয়েছেন ২ কোটি ১০ লাখ ৩৩ হাজার ৯৯৪ জন। সিএমএসএমই উদ্যোক্তা ৭৮ লাখ ১৩ হাজার ১৩৫ জন। অর্থাৎ ৯৯ শতাংশের বেশি। গত চার দশকে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ক্রমে বেড়েছে। আর গত দুই দশক দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই খাতের অবদান বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ৩৩.৮৫ শতাংশ।