এক অপরূপ দৃশ্য। চোখ মেললেই মন জুড়িয়ে যায়। পুরো মাঠ যেন ঢেকে আছে হলুদ গালিচায়। সরিষার রূপ আর গন্ধে মাতোয়ারা চারিধার। আর তারই বুকজুড়ে মৌমাছি, প্রজাপতির অবিরাম খেলা। এরই মধ্যে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে খেতের পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌয়ালরা। মৌমাছিরা সরিষার ফুলে ফুলে ঘুরে ঘুরে তুলে নেয় মধু, আর সেই মধু সংগ্রহ করতেই যেন মৌয়ালরা উৎসবে মেতেছেন।
বাজারে প্রচলিত বিদেশি মধুর ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ভারতের ডাবর, সাফোলা, লিটল বি, পাকিস্তানের বি হাইভস, অস্ট্রেলিয়ার অজিবি, সৌদি আরবের আল শিফা, দুবাইয়ের আল শাফি, নিউজিল্যান্ডের মানুকা হানি ইত্যাদি বিভিন্ন সুপারশপ ও খুচরা বিক্রয়ের দোকানে বিক্রি হয়। এছাড়া স্বপ্ন মধু, ট্রপিকা, এপি মধু, পুষ্টি মধুসহ বেশ কিছু দেশি ব্র্যান্ডও আছে। ব্র্যান্ড ছাড়া স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত মধুও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিক্রি হয়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও মৌমাছি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মধু সংগ্রহের উৎস আছে। এসব উৎসের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা গেলে বছরে ২০ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। সে হিসাবে বর্তমানে দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার সম্ভাবনা আছে এই খাত থেকে।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামে সরিষার মৌসুমে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মধু সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসেন মৌচাষিরা। শুরুটা অবশ্য ‘মতিমধু’ মৌচাষ প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রায় দুই যুগ আগে এই সাতগাঁওয়ে সরিষা মধু সংগ্রহের প্রকল্প শুরু করে তারা। মধু চাষ করে অর্জন করেছে জাতীয় পুরস্কারও। তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই শুরু হয় দেশের বিভিন্ন এলাকার মৌ চাষিদের আনাগোনা। মৌচাষিরা জানালেন, সরিষা ক্ষেতে মধু চাষ খুবই লাভজনক। এতে কৃষক ও মধু চাষি- দুই পক্ষই লাভবান হন। ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মৌমাছির ব্যাপক পরাগায়নে সরিষার বাড়তি ফলন পান কৃষক, আর মৌচাষিরা পান মধু। রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় গতকাল শনিবার বিকালে একটি সুপারশপে যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী শাকিলা আক্তার। সেখান থেকে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে শর্ষে ও কালিজিরা ফুলের দুই কেজি মধুও কেনেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে সারা বছরেও দুই কেজি করে মধু কিনতাম না, গত এক বছরে পরিবারের জন্য ৬ কেজির মতো মধু কিনেছি আমি।’ করোনা মহামারি শুরুর পর তার পরিবারে মধু ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানান শাকিলা। শুধু শাকিলা আক্তারই নন, করোনার সময় থেকে দেশের অনেক পরিবারেই মধু ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মধু উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রিও। বর্তমানে দেশে মধু ও এর উপজাত পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার বাজার আছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে দেশে মধু উৎপাদিত হয়েছে ১০ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন (১ মেট্রিক টনে ১ হাজার কেজি)। এর আগের অর্থবছরে মোট মধু উৎপাদিত হয়েছিল ৪ হাজার ৬২২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এক বছরে মধু উৎপাদন বেড়েছে ১৩০ গুণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপ্রকল্প পরিচালক ফ ম মাহবুবুর রহমান বলেন, ফসলের পরাগায়ন বাড়ানোই মৌমাছি চাষের মূল উদ্দেশ্য। দেশে যেসব মধু পাওয়া যায়, তা মূলত প্রাকৃতিক, চাষ ও আমদানি- এই তিনটি উৎস থেকে আসে। মোট উৎপাদিত মধুর ৯৫ শতাংশই আসে চাষের মাধ্যমে। দেশে প্রায় ৮ হাজার মৌচাষি আছেন। তারা ৭০ হাজার মৌমাছির বাক্সে মধু চাষ করেন। চাষের মধু ছাড়াও বসতবাড়ির আশপাশ ও বনাঞ্চলে মৌমাছির চাক থেকে প্রাকৃতিক মধু পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক মধুর বড় সংগ্রহ আসে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে। বন বিভাগ জানিয়েছে, সুন্দরবন থেকে গত অর্থবছরে প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন মধু (৩ হাজার কুইন্টাল) ও দেড় শ মেট্রিক টন মোম আহরণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপন্ন হয় দেশে। এর বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন মধু আমদানি হয়। খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মধুর প্রকারের ওপর এর দাম নির্ভর করে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মধু গড়ে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। সে হিসাবে দেশে উৎপাদিত ১০ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন মধুর দাম হয় ৬৩৯ কোটি টাকা। গত বছর দেশে প্রায় ৬০ কোটি টাকার মধু আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া মোমসহ মৌচাক থেকে পাওয়া অন্যান্য উপজাত বিক্রি হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে দেশে মধুর বাজার প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার। মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ জানান, জেলায় এবার ৭১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে, যা গতবারের চেয়ে প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর বেশি। মৌচাষের কারণে একদিকে সরিষার ভালো ফলন হচ্ছে, অপর দিকে অতিরিক্ত আয় হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর মধু। এবার সরিষার আবাদ, মৌয়াল বা মৌচাষি ও মৌবাক্সের সংখ্যা গতবারের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় মধুর উৎপাদনও বেশি হয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক স্পটে ১২ হাজারের বেশি মৌবাক্স নিয়ে মৌচাষিরা তাঁবু স্থাপন করেছেন। এসব মৌবাক্স থেকে এ মৌসুমে আশা করা যাচ্ছে অন্তত ১৮০ থেকে ২০০ টন মধু আহরণ করা যাবে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। মধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন মৌসুমে মানিকগঞ্জ, পাবনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। বিশেষ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে মানিকগঞ্জের সরিষার ফুল থেকে, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জের ধনিয়া, কালিজিরা ও গুজি তিলের ফুল থেকে এবং এপ্রিল-মে মাসে দিনাজপুরের লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়। এসব মধু ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। সুপারশপ স্বপ্নের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় ৬০ মেট্রিক টন মধু বিক্রি করে; এর মধ্যে ৪০ মেট্রিক টন আমদানি করা। অর্থাৎ মোট বিক্রির প্রায় ৬৫ শতাংশ আমদানি করা, বাকিটা স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা। গত এক বছরে মধু বিক্রি ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান তিনি।