ভালো ফলনেও বাড়ল চালের দাম

প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি বছর চাষ ও ফলন দুটোই বেশি হয়েছে আমনের। এখন পর্যন্ত ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ প্রায় ৯৮ ভাগ শেষ। তাতেই চাহিদার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে উৎপাদন। বাকি জমির ধান কাটা শেষ হলে উৎপাদনে আগের সব রেকর্ড ভেঙে যাবে। তারপরও বাজারে পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়েই চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে থেকে পর্যায়ক্রমে চালের দাম বাড়িয়েছে মিল মালিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, এ বছর আমাদের আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৬ লাখ ৫৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। সেখানে চাষ হয়েছে ৫৬ লাখ ৯৯ হাজার ১০০ হেক্টর। তাতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এখন পর্যন্ত ৫৫ লাখ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। ৯৮ শতাংশ ধান কাটা শেষে দেখা যাচ্ছে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ৫৬ হাজার ৯০০ টন। টার্গেটের চেয়ে ২১ হাজার ৯০০ টন কম আছে। বাকি ২ শতাংশ জমির ধান কাটা হলে উৎপাদনের টার্গেট ছাড়িয়ে যাবে। এ মৌসুমে চালের দাম কেন এত বাড়ল তা জানতে চাইলে নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন সরদার বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে হাটবাজারে ধানের আমদানি কমে গেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় প্রতি মণে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে। এতে চালের দাম বেড়েছে।

তিনি বলেন, মাত্র দুই সপ্তাহ আগে প্রকারভেদে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে ধান কেনাবেচা হয়েছে। সেই ধান এখন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা মণ দরে কিনতে হচ্ছে। বর্তমানে জেলার হাটবাজারে স্বর্ণা থেকে ৫ জাতের ধান ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৬০ টাকা, জিরা ধান ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৩০ টাকায় এবং চিকন জাতের কাটারি ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫৩০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায়। এদিকে নওগাঁর পাইকারি চাল আড়তে প্রতি কেজিতে স্বর্ণা থেকে ৫ জাতের চাল ৪৬ থেকে ৪৭ টাকায়, জিরা ৬২ থেকে ৬৪ টাকায় এবং চিকন কাটারি ৬৪ থেকে ৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাবুবাজার, ঠাটারিবাজার, জোয়ারসাহারা বাজারের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে। কারণ হিসেবে তারা দায়ী করছেন করপোরেট কোম্পানি ও মিল মালিকদের।

এদিকে চালের দামের পাশাপাশি একই সময়ে আটার দামও বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সাধারণ মানুষ আরো চাপের মধ্যে পড়ে গেছেন। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী শাহজাহান হোসেন বলেন, নাজিরশাইল চাল ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বিআর ২৮ চাল কেজিপ্রতি ৪ টাকা বেড়ে ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়, মিনিকেটে ৫ টাকা বেড়ে ৭০ টাকায়, কাটারি আতপ ৫ টাকা বেড়ে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাল এনে কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করেন মো. জসিম উদ্দিন। মিলাররা নির্বাচনকে ইস্যু করে কেজিতে ৪ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এই দাম বাড়ানোর কোনো কারণ ছিল না। এর আগে আউশ মৌসুমেও ধানের উৎপাদন ভালো ছিল। এবার আমনেও উৎপাদন ভালো হয়েছে। মিলাররা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছেন। ঠাটারিবাজারের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, মিনিকেট চাল ৬২ টাকা থেকে বেড়ে ৬৬ টাকা, নাজিরশাইল ৬৩ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা ও স্বর্ণা ও পাইজাম চাল ৪৬ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেন দাম বাড়ল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রশ্ন আপনারা মিল মালিকদের করেন। জোয়ারসাহারা বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. সায়েম বলেন, নির্বাচনের এক দিন পরেই হঠাৎ মিলাররা সিন্ডিকেট করে প্রতি বস্তা (৫০ কেজির) চালের দাম ২৫০ টাকার বেশি বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। যার কারণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চালের দাম বেড়ে গেছে। সাধারণত যখন চালের দাম বাড়ে তখন এক লাফে বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে বাড়ে। কিন্তু এবার এক লাফে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন মিলাররা। রাজধানীর শাহবাগে কথা হয় কামরাঙ্গীরচর থেকে আসা রিকশাচালক মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। চালের দাম নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় এই এক সপ্তাহে মোটা চাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে।

বাজারের অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, গত ১৫ দিনের মধ্যে একবার ব্রয়লার মুরগির মাংস খেয়েছি। ২০০ টাকা কেজির নিচে কোনো মাছ নেই। তরি থেকে তরকারির দামও বেশি। এদিকে ভাড়া কমে গেছে। সারা দিন রিকশা চালিয়ে ৩০০ টাকা নিয়েও ঘরে ফেরা যায় না। রাজধানীর বাবুবাজার ও বাদামতলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বলেন, আমনে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাড়তি দামে ধান কিনতে হয়েছে মিলারদের।

যে কারণে চালের দামও বাড়তি। এবার মিলার ও বড় করপোরেট কম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে বাড়তি দামে ধান কিনেছিল, যার প্রভাব এখন বাজারে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে করপোরেট কোম্পানিগুলোরই নিজস্ব মিল আছে। আবার তাদের বিভিন্ন দোকানও আছে। তারা প্রয়োজনে চাল মজুত করে ও সুযোগ বুঝে বাজারে ছাড়ে। কয়েক বছর আগেও এ অবস্থা ছিল না। এখন সবকিছু তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এদিকে চালের সঙ্গে বেড়েছে আটার দামও। দুই কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়, কয়েক দিন আগেও যা ছিল ১২০ টাকা। খোলা আটার দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা। ক্রেতার পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতারাও এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।