২০২৩ সালে প্রবাসী আয় ২ হাজার ১৯২ কোটি ডলার

হুন্ডির দাপটের মধ্যেও বাড়ছে রেমিট্যান্স

প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

জামালপুরের বাসিন্দা শফি মিয়া (আসল নাম নয়) সৌদি আরবে মেকানিক হিসাবে কাজ করছেন গত ৭ বছর ধরে। প্রতিমাসেই তিনি পরিবারের কাছে টাকা পাঠান। টাকা পাঠানোর জন্য তিনি জেদ্দার হামরার একটি এলাকার মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে টাকা জমা দেন। এর ২ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় তার পরিবারের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়া হয়। জনি মিয়া বলছেন, ‘ব্যাংকে যাওয়া ঝামেলা, কাগজপত্র চায়। আবার আমার বউকে টাকা তুলতে বাজারের ব্যাংকে যেতে হয়। তার চেয়ে এভাবে টাকা পাঠালে সহজে বাড়ির লোকজন হাতে টাকা পায়। আবার এখন দোকান থেকে পাঠালে ব্যাংকের চেয়ে কয়েক হাজার টাকা বেশিও পাওয়া যায়।’

তিনি বলছিলেন, সৌদি আরবের যে বাড়িতে তিনি থাকেন, সেখানে আরো ছয়জন বাংলাদেশি আর চারজন ভারতীয় নাগরিক থাকে। তারা সবাই এভাবেই দেশে টাকা পাঠান। জনি মিয়া যে প্রক্রিয়ায় দেশে টাকা পাঠান, প্রচলিত ভাষায় তাকে হুন্ডি বলা হয়। যা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ অর্থ লেনদেন। তবে সেই বিষয়ে জনি মিয়ার পরিষ্কার কোন ধারণা নেই। বিদেশে শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও আসছে না কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্স। বৈধভাবে অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থাপনার ঘাটতিকেই দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় সান্ধ্যকালীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ ব্যাংকারদের এবং সেবামূলক কার্যক্রম প্রবাসীদের দোড়গোড়ায় নিয়ে যেতে হবে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

সৌদি আরবে অনেক প্রবাসী কর্মসংস্থান এবং টাকা পাঠানোর ব্যবস্থার দূরত্ব বেশি হওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন না। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা আর রেমিট্যান্স পাঠাতে তাই তাকিয়ে থাকতে হয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। তবে ভিড় বেশি থাকা আর পরিবহনে বাড়তি খরচের বিপরীতে অনেকেই বেছে নেন হুন্ডিকে। তার সাথে আছে ডলারের দামের বিড়ম্বনা। এমন বিভিন্ন কারণেই আসছে না কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্স। এক প্রবাসী বলেন, আমরা থাকি রিয়াদ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূর একটি অঞ্চলে।

সেখানে থেকে বাতহাতে আমরা দেশের টাকা পাঠাতে ও বাজার করতে আসি। অনেক মানুষই ওখানে থেকে বাতহাতে আসতে চান না। কারণ, এখানে আসতে অনেক অর্থ ভাড়া দিতে হয়। আরেকজন প্রবাসী বলেন, ব্যাংকে যাওয়ার জন্য লম্বা সিলিয়াল ধরতে হয়। ফলে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে বিদেশ যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৬ লাখের ঘরে। পরের বছর থেকে এ সংখ্যা দাড়ায় দ্বিগুণে, যা ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। এ সংখ্যা ২০২৩ সালে গিয়ে ঠেকে প্রায় ১৩ লাখে। কিন্তু সে অনুযায়ী হাওয়া লাগেনি রেমিট্যান্সের পালে। ২০২১ সালে মোট রেমিট্যান্স আসে ২ হাজার ১২৩ কোটি ডলার। এর ধারবাহিকতায় ২০২২ সালে কিছুটা বাড়লেও বিদায়ী বছর আবারও নিম্নমুখি রেমিট্যান্স প্রবাহ। ২০২২ সালে রেমিট্যান্স আসে ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে এসেছে ২ হাজার ১৫৯ কোটি ডলার। এবিষয়ে গবেষকরা বলছেন, ব্যাংকিংসহ সব ধরনের সেবা প্রবাসীবান্ধব হতে হবে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, কর্তৃপক্ষকে সেবাবান্ধব মনোভাব রাখতে হবে। এটা না করে তারা যদি অফিস ৯ টু ৫ হিসাব করেন; স্যুট টাই পরে যদি অফিসেই বসে থাকেন; সার্বিক পরিবেশ যদি সরেজমিনে ঘুরে না দেখেন; প্রবাসীদের কাছে গিয়ে যদি তাদের সমস্যাগুলো না শুনেন; কোন কোন সেবা দিতে হবে, সেই অনুসারে টেকনোলজি যদি না দিতে পারে কর্তৃপক্ষ; তারা যদি ডিজিটাল কারেন্সি না আনতে পারে; আবার এমন এমন আইন করে রাখা হলো যে কে কত টাকা পাঠাচ্ছে বা কে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত কি না। তাহলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়বে না। ব্যাংকিং খাতে অবশ্যই তদারকির দরকার আছে। আবার একই সঙ্গে এটি প্রবাসীবান্ধব আমরা চিন্তাভাবনা করতে পারি কি না। প্রসঙ্গত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে গেছেন দেড় কোটির বেশি বাংলাদেশি।

এসব শ্রমিকের মধ্যে শুধু ২০২৩ সালেই গেছেন প্রায় ১৩ লাখ কর্মজীবী মানুষ।

বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের (সিএমএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, হুন্ডির মাধ্যমে অধিক মাত্রায় অর্থ পাঠানোর কারণে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। হুন্ডির প্রতি আগ্রহী হওয়ার সঙ্গে অভিবাসন ব্যয়ের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ঋণ নিয়ে উচ্চ খরচে বিদেশে যান প্রবাসীরা। তারা দেশে দ্রুত অর্থ পাঠিয়ে এই ঋণ পরিশোধ করতে চান। তাই যে মাধ্যম বেশি মুদ্রা বিনিময় হার দেয়, তাঁরা সেই মাধ্যমই ব্যবহার করেন।

বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে টানা দুই বছর (২০২২ ও ২০২৩ সাল) রেকর্ড হয়েছে। এই ২৪ মাসে নতুন করে বিভিন্ন দেশে ২৪ লাখের বেশি কর্মী গেছেন। অথচ ২০২৩ সাল শেষে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) তেমন বাড়েনি। অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা, বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে অতিরিক্ত প্রণোদনা দিয়েও বিদায়ী বছরে প্রবাসী আয় তেমন বাড়ানো গেল না।

প্রবাসী আয় তেমন বাড়াতে না পারার পেছনে অর্থ পাচার ও হুন্ডি-বাণিজ্যের সংশ্লিষ্টতা দেখছেন অভিবাসন খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিদেশে নতুন কর্মী যাওয়ার পর দেশে টাকা পাঠাতে সাধারণত ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। এই হিসাবে ২০২৩ সালে প্রবাসী আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। প্রবাসীদের টাকা ঠিকই দেশে এসেছে, তবে তা ব্যাংক হয়ে বৈধ পথে আসেনি।