সিন্ডিকেটের কব্জায় চালের মোকাম

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মান ও ধরনভেদে চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সদ্য শেষ হওয়া বছরে আমন ধানের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। কেবল সিন্ডিকেটের কারণেই চালের দাম বেড়েছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর কাওরান বাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুরসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়, ব্রি-২৮ চাল ৫৫ টাকা, নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, দেশি মোটা চাল ৫০ টাকা, পোলাওয়ের চাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। এছাড়া প্রতিটি চালের বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। নানা অজুহাতে মিলাররা বেশি দামে চাল বিক্রি করায় পাইকারি পর্যায়ে গত সপ্তাহে কেজিতে চার থেকে ছয় টাকা বেড়েছে চালের দাম। এর প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারেও। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত পুরোপরি স্থিতিশীল ছিল দেশের চালের বাজার। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকে শুরু করে মন্ত্রী পরিষদের শপদ নেয়ার পর চালের বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠে। লাগামহীন হয়ে উঠে সব ধরনের চালের দাম। ১১ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের দিনেই দাম বাড়ানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে, ৫০ কেজির প্রতি বস্তা নূরজাহান ২০০ টাকা, সিদ্ধ মিনিকেট আড়াইশ টাকা এবং দেশি বেথির দাম ৪০০ টাকা বেড়েছে। ৬ জানুয়ারি পাইকারিতে সিদ্ধ চালের মধ্যে প্রতি বস্তা জিরাশাইল ছিল ৩ হাজার ১৫০ টাকা, পাইজাম ২ হাজার ৫০০ টাকা, নূরজাহান ২ হাজার ৩০০ টাকা, মিনিকেট ২ হাজার ৩৫০ টাকা, ভিয়েতনাম বেতি ২ হাজার ২৫০ টাকা এবং দেশি বেতি ২ হাজার ৪০০ টাকা। যেখানে ১৪ জানুয়ারি প্রতি বস্তা জিরাশাইল ৩ হাজার ৩০০ টাকা, পাইজাম ২ হাজার ৬৫০ টাকা, নূরজাহান ২ হাজার ৫০০ টাকা, মিনিকেট ২ হাজার ৭০০ টাকা, ভিয়েতনাম বেতি ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং দেশি বেতি ২ হাজার ৮০০ টাকায় উঠে গেছে। সিদ্ধ চালের মতো আতপ চালের ক্ষেত্রেও ৩ হাজার ২০০ টাকার কাটারি হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, ২ হাজার ৭০০ টাকার মিনিকেট ৩ হাজার টাকা এবং ৩ হাজার ৪০০ টাকা নাজিরশাইল ৩ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে চিনিগুড়া চালের দাম প্রতি বস্তা ৯০০ টাকা বেড়ে উঠে গেছে ৭ হাজার টাকায়। দেশের উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলো থেকে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন প্রতি ট্রাকে ৩০০ বস্তা করে ৫০ ট্রাক চাল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারে এবং ৭৫ ট্রাক চাক্তাই চালপট্টিতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে মোকাম মালিকরা চাল পাঠাতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, করপোরেট হাউসগুলো বাজার থেকে ধান কিনে নিজেদের গুদামে মজুত করায় বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর মাঝে খাদ্য সংকটের গুজব রটিয়ে কিছু কিছু মোকাম মালিকও চাল মজুত করছে। এবিষয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বনিক সমিতির সহ সভাপতি জাফর আলম বলেন, যদি প্রতিটি গুদামে অভিযান চালানো হয়, তাহলে আমার মনে হয়, দাম আর বাড়বে না। ফলে মজুত করা চালও বাজারে ছাড়া হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ করে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মেসার্স আবদুল মান্নান সওদাগরের আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সরকারের কাছে চালের যে মজুত রয়েছে, তার প্রায় ১০ গুণ মজুত রয়েছে চালকলগুলোতে রয়েছে। কাজেই দাম বাড়ার বা সংকট হওয়ার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৩৩ মেট্রিক টন চাল, ১ লাখ ৯৮ হাজার ১০৩ মেট্রিক টন গম এবং ১৬ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন ধান মজুত রয়েছে। মাঠে উৎপাদিত আমন ধান সবেমাত্র গোলায় ফিরেছে। এর মাঝেই চালের দাম লাগামহীন। কারণ করপোরেট হাউসগুলো বাজার থেকে ধান কিনে গুদামে মজুত করছে এবং কারসাজি করে চাল বাজারে ছাড়ছে না। তাই চালের দাম গত কয়েক দিনে বেড়েছে বস্তা প্রতি ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এ সংকট থেকে উত্তরণে প্রতিটি জেলা প্রশাসককে ভূমিকা রাখার তাগিদ দিলেন চাল ব্যবসায়ীরা। এদিকে, চট্টগ্রামে কোনো মোকাম না থাকায় কুষ্টিয়া, নওগাঁ ও দিনাজপুর, আশুগঞ্জ জেলার মোকামের চালের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ অবস্থায় চালের জোগান স্বাভাবিক রাখতে উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের জেলা প্রশাসকদের টেলিফোনে অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।

উল্লেখ্য, ইরি-বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসতে আরও অন্তত ৪ মাস সময় লাগছে। এই সময়ের পুরো চাহিদা আমন দিয়েই মেটাতে হবে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, মিলারদের কারসাজিতে নতুন করে চালের বাজার অস্থির হচ্ছে। নানা অজুহাতে মিল মালিকরা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। এতে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও চালের দাম বাড়ছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও নতুন ও পুরোনো চাল বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাজারে আমনের চাল সরবরাহও হয়েছে ডিসেম্বরের শুরু থেকে। এখন এই সরবরাহ পুরোদমে থাকলেও মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরায় চালের দাম বেড়ে গেছে। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর ধানের আবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর বা সাড়ে ৯৭ শতাংশ জমির ধান। এখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২.৯৮ টন। গত বছরের শেষ দিকে পোকামাকড় এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান। এদিকে স্বল্প আয়ের মানুষকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণ করছে সরকার। চলতি অর্থবছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এসব কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির কার্যক্রমও। বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রথমবারের মতো সরকারের এই সংস্থা তাদের পণ্যে চাল যুক্ত করেছে, যা অনেক কম মূল্যে পাচ্ছে ক্রেতারা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে চাল বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকারি বিতরণ বাড়ায় চাল বিক্রি কমে গেছে। এ কারণে কয়েক মাস চালের দাম না বাড়লেও মিল পর্যায়ে সিন্ডিকেট করে এখন দাম বাড়ানো হচ্ছে।