একসময় এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংক গ্রহণ করত না। পরে চেক গ্রহণ করলেও সেই টাকা জমা হতে বেশ কয়েক দিন সময় লেগে যেত। আবার টাকা পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসাও ছিল জমজমাট। কেনাকাটা ও লেনদেনের পুরোটাই হতো নগদ টাকায়। তবে ২০২০ সালে করোনাভাইরাস সবকিছুই উল্টে দিয়েছে। ওই সময় দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় ইন্টারনেট ব্যবহারের বিপ্লব শুরু হয়। আর বিদায়ী বছরের শেষ দিতে হঠাৎ ঘরে বসে টাকা লেনদেনের সংখ্যা ও পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কারণে দেশের ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বিস্তার ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে তা আরো বেড়ে গেছে। এর পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নির্বাচন। গত অক্টোবর থেকেই ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন অনেক বেড়ে গেছে। কারণ ওই মাসে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ফলে গ্রাহকদের বড় একটা অংশ সশরীর ব্যাংকে যাওয়ার পরিবর্তে অনলাইন মাধ্যমকে বেছে নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপস ব্যবহার করে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রতি মাসের গড় লেনদেন ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। আর নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে লেনদেন বেড়েছে ৭৯ দশমিক ১৯ শতাংশ। মূলত গত অক্টোবরে হঠাৎ করে লেনদেন দ্বিগুণ হয়ে যায়, নভেম্বরেও অভ্যহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইতে দেশে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারী গ্রাহকের পরিমাণ ছিল ৭৪ লাখ ৪২ হাজার ৯৬৪জন। নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৭২ হাজার ৬৪৮ জন। আর জুলাইতে এসব গ্রাহক ৭৮ লাখ ৭ হাজার ১৭২টি লেনদেন করেছেন। নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৭ লাখ ৪৭ হাজার ২৪০টিতে। অর্থাৎ ৫ মাসের ব্যবধানে গ্রাহক ও লেদেন দুটোই বেড়েছে। একসময় কেনাকাটা ও লেনদেনের পুরোটাই হতো নগদ টাকায়। পরিষেবা বিল পরিশোধের জন্যও ব্যাংকগুলোতে লাইন লেগে থাকত। মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতেও প্রতিটি বাজার ও মহল্লায় ছিল একাধিক দোকান। কিন্তু ব্যাংকিং লেনদেনে এখন যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপসনির্ভর ব্যাংকিং সেবা। বর্তমানে দেশের প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপস দিয়ে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছেন। ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে হিসাবের স্থিতি জানা, যে কোনো ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর, পরিষেবা বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, কার্ডের বিল পরিশোধ, মাসিক সঞ্চয় হিসেবে টাকা জমাসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায়। ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। গাড়িতে আগুনসহ নানা ধরনের নাশকতা হয়েছে। এ কারণে অনেক গ্রাহক সরাসরি ব্যাংকিং বা কেনাকাটা বাদ দিয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা অলাইনে কেনাকাটা করেছেন। এ কারণে লেনদেন বেড়ে যেতে পারে।’ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রোথ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অ্যাপসে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্রাহক যুক্ত হচ্ছেন।
এরই মধ্যে অ্যাপসের গ্রাহক ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। এখন মাসে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে অ্যাপসে। গ্রাহক ও লেনদেন বাড়াতে নানা অফার দিয়েছি আমরা, যাতে ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি পায়। তবে লেনদেন বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য ভালো। আমরা চাই এটা অব্যহত থাকুক।’ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাপস ‘আস্থা’ দুই বছর ধরে বাজারে আছে। ব্যাংকটি নতুন করে সাজিয়েছে অ্যাপসটি। যাতে মিলছে আর্থিক সেবার পাশাপাশি আরো অনেক সুবিধা। ব্যাংকটি অ্যাপসে লেনদেনে কোনো মাশুল নিচ্ছে না। তবে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জানুয়ারিতে দেশের জাতীয় নির্বাচন ছিলো। এই সময় সাধারণত অপদর্শিত অর্থ লেনদেন বেড়ে যায়। নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্যায়ে অনেক ধরনের লেনদেন হয়, যা তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে করতে চায় না। এ কারণে পাড়া মহল্লার মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের টুলসগুলো ব্যবহার করে। এখন দেখার বিষয় নির্বাচনের পর এই লেদদেন কতটুকু অব্যহত থাকে।’ দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে। লেনদেনের প্রায় অর্ধেকই করেন ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা। এরপর রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অ্যাপস নেক্সাস পে, সিটি ব্যাংকের সিটি টাচ, ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা, ইস্টার্ণ ব্যাংকের স্কাই ব্যাংকিং।